লাগামহীন বাড়ি ভাড়া, নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নেই

।। ক্যাব সমীক্ষা ।।

রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসাভাড়া বাড়ছে। যদিও আইন আছে, আর আইন প্রয়োগের জন্য সরকার ও তার বাহিনী আছে। কিন্তু লাগামহীন বাড়ি ভাড়ায় বিপর্যস্ত নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। ঢাকা মহানগরীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমন্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ৩০ জন ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। অথচ একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। বাড়িভাড়া ও নিত্যপণ্যের দামের এই হিসাব উঠে এসেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক সমীক্ষায়।

ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ১৯৯০ সালে পাকা ভবনে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ২ হাজার ৯৪২ টাকা। ২০১৫ সালে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ টাকা। গত বছর এই ভাড়া এসে ঠেকেছে ২১ হাজার ৩৪০ টাকায়। ২০০৬ সাল থেকে গত ১০ বছরে ভাড়া বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে ২০০০-২০১০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে নগরায়ণের গতি ছিল বেশি। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ লোক শহরে বসবাস করে। বাড়িভাড়া বাড়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে লোকজন নানা কারণে ঢাকামুখী। যে কারণে চাহিদা এ জোগানের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। নতুন ফ্ল্যাটে গ্যাস বা বিদ্যুৎ নেই। ফলে পুরোনো বাড়িগুলোতেই ওঠে মানুষ। রিহাবের তথ্য অনুসারে এখন ঢাকায় প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট ফাঁকা পড়ে আছে।

ক্যাবের সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাসাভাড়া বৃদ্ধি একটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাড়িভাড়া বেড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের। যেসব এলাকায় এই শ্রেণির মানুষ বসবাস করে, সেসব এলাকায় বাসার চাহিদাও বেশি, তাই এখানে বাসাভাড়া বেশি বাড়ে। গুলশান বা বনানী এলাকার বাড়িভাড়া ততটা বাড়েনি। এই এলাকাগুলোয় নতুন নতুন বাড়ি হচ্ছে বলেই বাড়িভাড়া সে অনুপাতে বাড়েনি। রাজধানীতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাসের জন্য সরকারি পর্যায়ে আবাসন সৃষ্টি করলে বাসাভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়া ঢাকায় মানুষ আসা নিয়ন্ত্রণের কথা বললেন তিনি। গোলাম রহমান জানান, যে এলাকায় যে বসবাস করে, সে এলাকায় যদি তাঁর কর্মসংস্থান করা যায়, তাহলে ঢাকার ওপর চাপ কমবে। এতে বাসা ভাড়ার চাহিদা কমে আসবে। এভাবেও বাসা ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। বর্তমানে প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি ১৯৯১ সালের। কিন্তু সরকার এখনো এই আইনের বিধি করেনি। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১–এ বলা আছে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না। মানসম্মত ভাড়া, বাড়ি-মালিক বা ভাড়াটের আবেদনের ভিত্তিতে প্রতি দুই বছর পর (নিয়ন্ত্রক কর্তৃক) পুনর্নির্ধারণ করা যাবে। ভাড়াটে কর্তৃক ভাড়া পরিশোধ করা হলে বাড়ির মালিক তৎক্ষণাৎ ভাড়া প্রাপ্তির একটি রসিদ বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করে ভাড়াটেকে প্রদান করবেন।

আইনটিতে আরও বলা রয়েছে, ‘আইনের এসব বিধান না মানলে আইনের অন্য কিছু বিধিনিষেধ ব্যতীত মানসম্মত ভাড়া অপেক্ষা অধিক ভাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রহণ করলে প্রথমবারের অপরাধের জন্য মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ এবং পরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিন গুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।’ এই আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো ভাড়াটের কাছে জামানত বা কোনো টাকা দাবি করতে পারবেন না বাড়িওয়ালা। এক মাসের বেশি অগ্রিম ভাড়া নেওয়া যাবে না। প্রতি মাসে ভাড়া নেওয়ার রসিদ দিতে হবে, নইলে বাড়িওয়ালা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দুই বছর পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো যাবে না। ভাড়াটেদের স্বার্থরক্ষায় এমন আরও অনেক কথাই উল্লেখ আছে এই আইনে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ কার্যকর করতে ২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিল। রিট আবেদনের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আইনটি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আদালতের মাধ্যমে ভাড়াসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির কথা আইনে বলা আছে। এইচআরপিবির রিট আবেদনটির পরিপ্রেক্ষিতে রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১ জুলাই আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয়, বিদ্যমান আইনটি কার্যকর না হওয়ায় ভাড়াটেকে সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। আইনটি কার্যকরে রাষ্ট্রকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে; অন্যথায় সাধারণ মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ পাবে না। রায়ে সারা দেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে কমিশন গঠন করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু রায় ঘোষণার আড়াই বছর পেরোলেও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠিত হয়নি।

মনজিল মোরসেদ বলেন, এ বছরের জানুয়ারিতে বাড়িভাড়া আইনটির নানা দিক নিয়ে আবার হাইকোর্ট শুনানি হয়। সে সময় সদ্য অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া আবার শুনানির কথা বলেন। তাঁর পরে আবার প্রধান বিচারপতি বদলেছে। সে অনুসারে আগের সব সিদ্ধান্ত নতুন করে হবে বলে জানান মনজিল মোরসেদ। আইনে তিনটি বিষয়ে সুপারিশের তাগিদ দেওয়া হয় জানিয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, বাড়িভাড়া নির্ধারণে কমিশন গঠন, ওয়ার্ডভিত্তিক বাড়িভাড়া সমস্যার সমাধান ও ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়ি ভাড়া দেওয়া। মনজিল মোরসেদ বলেন, এর একটি ধারা সরকার বাস্তবায়ন শুরু করেছে তা হলো, ২৫ হাজার টাকার বেশি বাড়িভাড়া হলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা। যদিও ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য এটি কৌশলে অনেক বাড়িওয়ালা এটি এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।

বাড়িভাড়া নিয়ে সংক্ষুব্ধ হলে ঢাকার আদালতে মামলা করতে পারেন। এ জন্য যে–কেউ ঢাকার সহকারী জজ আদালতগুলোতে প্রতিকারের জন্য মামলা করতে পারেন। বাড়িভাড়াসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা কত, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই কারও কাছে। তবে এ ধরনের মামলা কম হয় বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, বাড়ির মালিকের সঙ্গে মামলা করে সেই বাড়িতে টিকে থাকা কষ্টকর, তাই ভাড়াটেরা মামলা করেন না বললেই চলে।

তাহলে সমাধান কী? বাড়িভাড়া কি বাড়তেই থাকবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। আইন ও বিধি যথোপযোগী করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ঢাকায় কেন মানুষের এত ভিড়, তারও সমাধান করতে হবে। সবকিছুকে ঢাকামুখী করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশব্যাপী সুযোগ সুবিধা প্রসারের মাধ্যমে ঢাকার ওপর চাপ কমানোর জন্য বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।