২৫ টাকা লাভে বিক্রি করলেও চালের বাজার অনিয়ন্ত্রীত

ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক:

এক কেজি চাল উৎপাদনে খরচ ৩৩ টাকা হলেও তা বাজারে ৫২-৫৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়। এরপরও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরে নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন মিলাররা। কখনও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া আবার কখনও সরবরাহে ঘাটতি বলে চালের দাম বাড়ানো হয়। অথচ কৃষক বলছেন, মৌসুমের শুরুতেই সব ধান বিক্রি দেন। তারা মজুত করেন না। তাদের কাছ থেকে কিনে ধান মজুত করে সারা বছর মুনাফা করছেন মিলার ও ব্যবসায়ীরা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি আমন মৌসুমে ৩৩ শতক জমিতে ব্রি ধান-৪৯ আবাদ করেছেন ময়মনসিংহ সদরের ঘাগড়া ইউনিয়নের সুহিলা গ্রামের কৃষক জুয়েল রানা (৩০)। ইতোমধ্যে ধান কেটে ঘরে তুলেছেন। তিনি ধান পেয়েছেন ১২ মণ। চাষাবাদ থেকে শুরু থেকে ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত সর্বমোট আট হাজার ৯০০ টাকা খরচ হয়েছে এই কৃষকের।

ধান চাষে খরচের বর্ণনা দিয়ে কৃষক জুয়েল রানা জানান, ৩৩ শতক জমিতে আমন আবাদের জন্য ধানের বীজ কিনেছেন ৩০০ টাকার। আষাঢ় মাসে চারা করতে বীজতলা চাষ ও শ্রমিকসহ খরচ হয়েছে এক হাজার টাকা। ভাদ্র মাসের প্রথম দিকে চারা রোপণের জন্য জমি চাষাবাদে খরচ হয়েছে এক হাজার টাকা। ৫০০ টাকা মজুরিতে তিন শ্রমিক দিয়ে চারা রোপণে খরচ হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা। ক্ষেতে নিড়ানি দিতে ৪০০ টাকা মজুরিতে তিন শ্রমিকের পেছনে খরচ এক হাজার ২০০ টাকা। প্রতি কেজি ২০ টাকা দরে ইউরিয়া সার প্রয়োগে খরচ হয়েছে ২০০ টাকা, ধান পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষায় কীটনাশক ব্যবহারে খরচ হয়েছে এক হাজার ২০০ টাকা।

সর্বশেষ ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ৫০০ টাকা মজুরিতে পাঁচ শ্রমিকের পেছনে খরচ হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা। তিন শতক জমিতে ১২ মণ ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে আট হাজার ৯০০ টাকা। হিসাবে প্রতিমণ ধান উৎপাদনে ৭৪১ টাকা খরচ হয়েছে তার।

বাজারে এখন প্রতি মণ আমন ধান বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০ টাকা। হিসাবে জুয়েল রানার প্রতি মণ ধান উৎপাদনে খরচ বাদে আয় ৩০৯ টাকা।

জুয়েল রানা জানান, এবার প্রত্যেক কৃষকের আমন ধানের ফলন ভালো হয়েছে। বাজার দর ভালো থাকায় কৃষক লাভবান হচ্ছেন। তিনি আগামীতে আরও বেশি জমিতে ধান আবাদের কথা ভাবছেন।

দুলাল উদ্দিন জানান, এক একর জমিতে আমন ধান আবাদ করে প্রতিমণে উৎপাদন খরচ পড়েছে ৭৯৮ টাকা এবং বিক্রি করে পাচ্ছেন এক হাজার ৫০ টাকা। অনেক কৃষক ধার করে ধান চাষ করেন। ধারের টাকা পরিশোধ করতে ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে কম দামে বিক্রি করে দেন। তিনি বলেন, সহজ শর্তে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করলে লাভবান হতেন কৃষকরা।

তারাকান্দার বালিখা গ্রামের কৃষক শামসুল হক জানান, ধানের উন্নতজাত আসায় আগের চেয়ে অনেক বেশি ফলন হয়। তবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা তেমন লাভবান হচ্ছেন না। উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারকে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

ফুলপুরের বালিয়া গ্রামের কৃষক সালাম মিয়া জানান, কৃষি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষককে চাষাবাদে বেশি বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগকে আরও আন্তরিক হয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাটের শাকুয়াই গ্রামের কৃষক আব্দুল করিম জানান, সরকার আমনের বাজার দর আগে থেকেই প্রতি কেজি ২৭ টাকা হিসাবে এক হাজার ৮০ টাকা মণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে বাজারে আগাম আমন ধান প্রতি মণ এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে খাদ্য অধিদফতর ধান কিনলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং লাভবান হবেন।

সদরের গোপালনগর গ্রামের কৃষক তালেব উদ্দীন আমন মৌসুমে ৩০ শতক জমিতে আবাদ করে সাড়ে ১২ মণ ধান পেয়েছেন। প্রতি মণ ধান উৎপাদনে তার খরচ ৭২০ টাকা। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি করছেন এক হাজার ৫০ টাকা। খরচ বাদে প্রতি মণ ধান উৎপাদন করে তিনি লাভ করছেন ৩৩০ টাকা। তালেব উদ্দীন প্রতি মণ ধান থেকে চাল তৈরি করে পেয়েছেন ২৬ কেজি। বর্তমানে খুচরা বাজার দর অনুযায়ী প্রতি কেজি চাল ৪৮ টাকা। হিসাবে ২৬ কেজির দাম হয় ১২৪৮ টাকা।

কৃষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মণ ধান উৎপাদনে খরচ ৭২০ টাকা। এক মণ ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে ভাঙাতে খরচ হয় ১৫০ টাকা। সবমিলে খরচ ৮৭০ টাকা। হিসাবে চালের কেজি পড়ে ৩৩ টাকা।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, এসব চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। হিসাবে প্রতি কেজি চালে মুনাফা ২২ থেকে ২৫ টাকা।

কৃষক তালেব উদ্দীন জানান, ধান ঘরে তুলে পাইকারদের কাছে সরাসরি বিক্রি করে দেওয়া ভালো। ধান থেকে চাল বানিয়ে বিক্রি করলে তেমন লাভ হয় না।

এদিকে, প্রতি কেজি ধানের দাম ২৭ টাকা এবং চালের দাম ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। প্রকৃতপক্ষে কৃষকের জন্য এমন দাম নির্ধারণ হলেও বেশি মুনাফা মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে যায়।

ময়মনসিংহের রাইস মিল মালিকরা বর্তমানে এক হাজার ৫০ টাকা মণে আমন ধান কিনছেন। সদরের শম্ভুগঞ্জ হাজী অটোরাইস মিলের মালিক হাজী মোহাম্মদ এরশাদ আলী বলেন, বর্তমানে এক হাজার ২০ টাকা দরে ধান কিনছি। রাইস মিল পর্যন্ত আনতে শ্রমিক এবং গাড়ি বাবদ খরচসহ মণ পড়ছে ১০৫০ টাকা। প্রতি মণ ধান ভাঙতে খরচ হয় ৫০ টাকা। সবমিলে প্রতি মণে খরচ ১১০০ টাকা। প্রতি মণ ধান থেকে চাল হয় ২৬ কেজি। পাইকারি বাজার দর অনুযায়ী ২৬ কেজি চালের দাম ১০৫০ টাকা। হিসাবে প্রতি মণ ধান থেকে চাল তৈরি করে ৫০ টাকা লোকসান গুনতে হয়।

তিনি আরও বলেন, সরকার আগে থেকে ধানের এবং চালের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় ধানের দাম বেড়ে গেছে। এবার কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মিল মালিকরা সরকারি গুদামে চাল দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

সদরের চুরখাই বাজার এলাকার এ রহমান অটোরাইস মিলের মালিক মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ধানের বাজার অনেক চড়া। এরকম বেশি দাম থাকলে মিল মালিকরা ধান কিনতে পারবেন না। বর্তমানে আমন ধান কিনে চাল তৈরি করে পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে গেলে প্রত্যেক মিল মালিককে লোকসান গুনতে হয়। তবে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন।

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. মতিউজ্জামান  বলেন, জেলার প্রকৃত কৃষকদের তালিকা খাদ্য অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী ধান সংগ্রহ করলে সরকারের বেঁধে দেওয়া ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারবেন কৃষক। সেই সঙ্গে লাভবান হবেন।