জ্বালানি সনদ চুক্তিতে স্বাক্ষর ভয়ংকর ঝুঁকিতে ফেলবে বাংলাদেশকে

মুজাহিদুল ইসলাম: একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে অন্যতম পূর্বশর্ত হলো জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাই একটি গতিশীল রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য থাকতে হয় যাতে যতটা সম্ভব কম মূল্যে নাগরিকদের কাছে জ্বালানি সরবরাহ করা যায়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩-এর মূলনীতি হলো- জ্বালানিতে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা, নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং জ্বালানিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করা। কিন্তু বাংলাদেশে জ্বালানির বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয় এবং ভোক্তার জ্বালানি অধিকার কখনোই নিশ্চিত হয়নি।

বাংলাদেশে ভোক্তার জ্বালানি নিরাপত্তা এমনিতেই যেখানে প্রশ্নের সম্মুখীন সেখানে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সনদ চুক্তিতে স্বাক্ষর হবে নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে সনদে স্বাক্ষর করেছে এবং এখন একটি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র। ২০১৯ সালে এই সচিবালয়ের এক কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফরের বরাতে জানা যায়, বাংলাদেশ আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক জ্বালানি সনদ চুক্তি বা বাংলাদেশ এনার্জি চার্টার ট্রিটি স্বাক্ষরের প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ফেলেছে।

অবশ্য ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী অষ্টম আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্মেলনে স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। তার মানে হল বাংলাদেশ এই চুক্তিটি যে কোনো সময় স্বাক্ষর করার জন্য প্রস্তুত। জ্বালানি সনদ চুক্তি বাংলাদেশের জন্য পরিষ্কার ভাবে জনস্বার্থবিরোধী এবং এটি বাংলাদেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। একই সঙ্গে এটি বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করবে।

জ্বালানি সনদ চুক্তিসংক্রান্ত প্রাথমিক ধারণার সূচনা ঘটে ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত ডাবলিনের এক সভায়। সভায় সেই সময়কার ডাচ প্রধানমন্ত্রী রুড লুবার প্রথমবারের মতো একটি নিজস্ব ইউরোপীয় জ্বালানি মণ্ডলী গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাবের হাত ধরেই আবির্ভূত হয় জ্বালানি খাতের বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারীর নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষায় ইউরোপীয় জ্বালানি সনদ বা ইউরোপিয়ান এনার্জি চার্টার। তবে এই সনদের আইনগত প্রয়োগ স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না, ছিল ঐচ্ছিক। সনদটি এখন হালনাগাদ হয়ে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক জ্বালানি সনদ নামে একটি রাজনৈতিক ঘোষণা ও প্রতিজ্ঞা সনদ হিসেবেই টিকে আছে। চুক্তিটি ১৯৯৮ সাল থেকে কার্যকর হয় এবং আইনগুলো বাধ্যতামূলক করা হয়। বর্তমানে ৫৪টি দেশ ও অর্থনৈতিক জোট চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।

৫০টি ধারা নিয়ে প্রণীত ইসিটি (জ্বালানি সনদ চুক্তি) মোট আট ভাগে বিভক্ত। মোটা দাগে ৪টি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এর আইনি কাঠামো। সেগুলো হলো : ১. স্বদেশী-বিদেশি নির্বিশেষে সমাচরণ (ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট); ‘মোস্ট ফেভার্ড নেশন’ বাণিজ্যনীতির ভিত্তিতে বিদেশি বিনিয়োগের সুরক্ষা; ২. বিভিন্ন জ্বালানি উপাদান, পণ্য, সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিকে পাইপলাইন, গ্রিডের মাধ্যমে বা অন্যান্য উপায়ে স্থানান্তর ও পরিবহন; ৩. আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও স্বাগতিক রাষ্ট্র বনাম বিদেশি বিনিয়োগকারী দ্বন্দ্ব নিরসন; ৪. অধিক কার্যকরভাবে জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত এবং জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারের কারণে পরিবেশগত ঝুঁকি হ্রাস।

এই সনদের ধারা ৫, ১১ ও ১৪ অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বাগতিক রাষ্ট্র স্থানীয় কোনো পণ্য ব্যবহারে বিনিয়োগকারীকে বাধ্য করতে পারবে না। এমনকি জনবলও নিতেও বাধ্য করা যাবে না। ভোক্তার জন্য জ্বালানি মূল্য কমালে এবং এতে যদি বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বিনিয়োগকারী মামলা করতে পারবে। এই সনদে সই করলে বিদেশি কোম্পানি বিনা বাধায় তাদের পুঁজি, মুনাফা ফেরত নিয়ে যেতে পারবে। সবচেয়ে বিপদজনক হচ্ছে, বিনিয়োগসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব নিরসনে অতি ব্যয়বহুল আন্তর্জাতিক সালিশের দারস্থ হতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যান্য আইনের মতো প্রাথমিক ধাপে স্বাগতিক রাষ্ট্রের আদালতে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। এই সনদ আইনি কাঠামো অনেকটাই একপেশে এবং ভারসাম্যহীন। এটা স্বাগতিক রাষ্ট্রের জন্য এক রকমের আইনি ফাঁদ। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের জন্য জ্বালানি সনদ চুক্তি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।

চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অনেক দেশই এখন এই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার কথা ভাবছে। জ্বালানি সনদ চুক্তির মূল উদ্যোক্তা নেদারল্যান্ডস-ই এখন এই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের চেষ্টা করছেন। কিন্তু বের হওয়ার পরও ২০ বছর পর্যন্ত চুক্তির শর্ত বহাল থাকে। এ জন্য এটি বিশ্বজুড়ে জম্বি (ভূত) চুক্তি নামে পরিচিত। ইতালি বের হয়ে যাওয়ার পরও এ চুক্তির আওতায় মামলায় পড়েছে। জার্মানি, ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ চুক্তি থেকে বের হওয়ার চিন্তা করছে। ২০২১ সালে নেদারল্যান্ডস কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ সরে আসার আইন পাস করলে জার্মানিভিত্তিক জ্বালানি কোম্পানি ইউনিপার ১ বিলিয়ন ইউরো ও আরডব্লিউই এজি ১.৪ বিলিয়ন ইউরোর ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে আইএসইডিতে জ্বালানি সনদ চুক্তির আওতায়। জ্বালানি রূপান্তর করতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে ৪৫টি রাষ্ট্র এ ধরনের মামলার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে কমপক্ষে ২০টি রাষ্ট্র সনদ চুক্তির স্বাক্ষরকারী।

একটি দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো জ্বালানির মূল্য স্থিতিশীল থাকা। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি বাংলাদেশে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করায় কী ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছে অর্থনীতি। ছোবল হেনেছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার ওপর। ভোগ কমেছে, জীবনযাত্রার মান কমেছে, ছোট হয়েছে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকাও।

বাংলাদেশের মতো একটি অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদের দেশে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যতটা সম্ভব সাশ্রয়ী মূল্যে নাগরিকদের কাছে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। প্রয়োজনে জ্বালানিতে ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি মূল্য ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার নাগালে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু জ্বালানি সনদ চুক্তি এর অন্তরায়। বাংলাদেশ যদি জ্বালানি সনদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তাহলে জনগণের স্বার্থে জ্বালানির মূল্য কমানোর সুযোগ হারিয়ে ফেলবে। কারণ জ্বালানি মূল্য কমালে এবং এতে যদি বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বিনিয়োগকারী মামলা করতে পারবে।

যেমনটা ঘটেছে হাঙ্গেরি এবং বুলগেরিয়ার সঙ্গে। ভোক্তার জন্য জ্বালানি মূল্য কমানোর কারণে স্বাগতিক রাষ্ট্র হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে ব্রিটিশ সাবসিডিয়ারি এপ্লাইড এনার্জি সার্ভিসেস এবং অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মাইনিং কোম্পানি ইভিএন ২০১৩ সালে বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে জ্বালানি সনদ চুক্তির আওতায় আইসিআইডিতে ক্ষতিপূরণ মামলা করে। যদিও এ মামলার রায় স্বাগতিক রাষ্ট্রের পক্ষে গেছে কিন্তু আইন অনুযায়ী ট্রাইবুনালের ব্যয় মামলাকারী বিদেশি কোম্পানির সাথে ভাগাভাগি করতে হয়েছে। হাঙ্গেরিকে এই মামলার পেছনে ব্যয় করতে হয়েছিল প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ থেকে স্পষ্ট যে জ্বালানি সনদ যুক্তিতে স্বাক্ষর বাংলাদেশে জ্বালানি খাতের জনস্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলবে।

বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১০ অনুযায়ী, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিংহভাগ আসবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। মোট উৎপাদনের ৩২% বিদ্যুৎ আসবে কয়লা এবং ৪৩% আসবে এলএনজি থেকে। যদিও বাংলাদেশ জলবায়ুসংক্রান্ত প্যারিস সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র এবং গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ বর্তমান পর্যায় থেকে ২১.৮৫% কমিয়ে আনবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে জ্বালানি খাতই কার্বন নিঃসরণের ৫৫% এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নির্ভর উন্নয়ন ধারণার বাস্তবায়ন এবং এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই খাতের প্রতি মনোযোগী হয়েছে অনেক বেশি। ২০১৮-১৯ সালে শুধু বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল, যা ছিল মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৩২.৩২%।

বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বৈশ্বিক পরিবেশগত ঝুঁকির সম্মুখীন এবং অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। কার্বন নিঃসরণ, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। যেখানে বাংলাদেশের জন্য জরুরি কার্বনযুক্ত জ্বালানির ব্যবহার কমানো সেখানে ইসিটি তে স্বাক্ষর বাংলাদেশের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। ইসিটিতে স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশ চাইলেও আর জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসতে পারবে না। ইসিটিতে স্বাক্ষরকারী কোনো রাষ্ট্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের ব্যাপারে সচেষ্ট হলে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগকারীর জন্য তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রে জ্বালানি সনদ চুক্তিকে আইনগতভাবে ব্যবহার করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জ্বালানি রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

জ্বালানি রূপান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানিবিরোধী গৃহীত পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য জ্বালানি সনদ চুক্তির বিনিয়োগ বিরোধ নিরসন পদ্ধতিকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং ধনী বিনিয়োগকারী বা কোম্পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কাঠামোগত সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দায়মুক্তি আইন ২০১০ এর কারণে এই খাত ইতোমধ্যে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ঊর্ধ্বে উঠে এক প্রশ্নবিদ্ধ কাঠামোতে আবদ্ধ। এখন যদি নতুন করে জ্বালানি সনদ চুক্তি যুক্ত হয় তাহলে তা দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীর অনুকূলে আরও শক্তিশালী হবে। এসব বিবেচনায় জনস্বার্থ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষার তাগিদে জ্বালানি সনদ চুক্তি স্বাক্ষর থেকে বাংলাদেশকে বিরত রাখতে জোর প্রচারণা প্রয়োজন।

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সৌজন্যে, কালবেলা।