মূল্য বৃদ্ধির দায় নেবে কে?

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা মহামারির পর থেকে অধিকাংশ মানুষের জীবনেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। বিগত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বারবার লকডাউনে সীমিত আয়ের মানুষের একদিকে আয় কমেছে, অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বিশাল শ্রেণির কর্মক্ষম মানুষ। এর মধ্যে নতুন উপসর্গ যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের বাজার।

দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের দুমুঠো অন্ন জোগাড় করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে নিত্য খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। অথচ করোনা চলাকালীন সময়েও এভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়েনি। শুধু যে খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে, তা নয়। বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম। যেমন মাস তিনেক আগে বাজারে ১০০ গ্রাম ওজনের সাবানের দাম ছিল ৩৫ টাকা। সেটা এখন ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বেড়েছে ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, নারকেল তেল, শৌচাগারে ব্যবহার করা টয়লেট টিস্যুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। এক প্যাকেট টিস্যুর দাম ছিল ১৭ টাকা, যা এখন ২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ফলে টিস্যুর পেছনে একটি পরিবারের মাসিক ব্যয় ১৮ শতাংশ বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা নিত্য ভোগ্য ও ব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিকে অজুহাত দেখান। তবে ভোজ্যতেল ও চালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমতির দিকে হলেও আমাদের দেশে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ব্যবসায়ীদের অনেক আগের আবেদনের প্রেক্ষিতে।

ঢাকা শহরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি টিম বাজার তদারকি করার কথা থাকলেও বাজারে ভোক্তারা এই টিমের দেখা পান না।

ভারতে বন্যার অজুহাতে দেশীয় পেঁয়াজের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল। সরকার আমদানি শুল্ক হ্রাস করা, ভারত ছাড়াও মায়ানমার, তুরস্ক, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন উৎস থেকে আমদানি করায় দাম এখন কমতির দিকে। অথচ সরকার থেকে বলা হচ্ছে, পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদার ৮০ শতাংশ দেশীয় উৎপাদন দিয়ে মেটানো হয়। ২০ শতাংশ আমদানি করতে হয়, যার সিংহভাগ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু এই ২০ শতাংশ আমদানিই দেশীয় পেঁয়াজের বাজারকে অস্থির করে তোলে। সেকারণে অনেক বাজার বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা সরকারের এই পরিসংখ্যানকে মানতে নারাজ। কারণ ব্যবসায়ীরা বলতে চান, সরকারের পরিসংখ্যান সঠিক তথ্য তুলে আনতে পারছে না। আর বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ব্যবসায়ীরা সরকারকে বিভ্রান্ত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়।

সেকারণে তথ্য বিভ্রাট হলে ব্যবসায়ীরা নতুন একটি অজুহাত পায়। তাই ভারতে কোনো কারণে পণ্য সরবরাহ বিঘ্ন ঘটলে বাংলাদেশে দাম বাড়বে সেটা যুক্তিসংগত কারণ নয়। এছাড়াও যে পণ্য বাংলাদেশের বাজারে বাইরে থেকে আসেনি, তার দাম বেড়ে যাবে সেটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপণ্যের বাজার পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে দাম বাড়ালেও দাম কমলে বলছে, বেশি দামে কেনাসহ নানা অজুহাত।

করোনাকালে যেখানে অধিকাংশ পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকলেও করোনার লকডাউন পরবর্তীতে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ভোক্তাদের নাভিশ্বাস তৈরি করছে। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে জীবন-জীবিকাকে নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

আবার নিত্যপণ্যে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথাবার্তা উঠলেই ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দোষারোপ করেন। অন্যের ঘাড়ে দায় চাপাতে চান। মাঝে মাঝে বলে থাকেন, সরকার কেন বাজার তদারকি করছে না। তবে বাজারে তদারিক টিম পাঠাতে বললেও তাদের ব্যবসায় নয়, অন্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর পরামর্শ দেন। তাদের প্রতিষ্ঠানে পাঠালে পরিস্থিতি অস্থির হতে পারে।

প্রছন্ন একটি হুমকি প্রদান করে বাজার তদারিকতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চান। সেকারণে ঢাকা শহরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি টিম বাজার তদারকি করার কথা থাকলেও বাজারে ভোক্তারা এই টিমের দেখা পান না।

জেলা শহরে জেলা প্রশাসনের বাজার তদারকি টিম মাঠে থাকার কথা থাকলেও অনেকেই ফটো সেশনের মতো বাজার তদারকি করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিলেও এই তদারকি কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। তবে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা দিয়ে খুচরা বাজারে কিছু অভিযান পরিচালিত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জেলা বাজার কর্মকর্তা শুধুমাত্র পাইকারি দোকানের বাজার দর সংগ্রহ করেন, যার সাথে ভোক্তার সংশ্লিষ্টতা কম। যে কারণে ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অনুযায়ী দোকানে মূল্য তালিকা টাঙানোর নির্দেশনা আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। এখন দেখা যায়, ভোক্তা বা প্রশাসনের লোকজন কোনো কারণে বাজারে গেলেই মূল্য তালিকা টাঙানোর হিড়িক পড়ে। আবার তারা বের হলেই এই তালিকা উঠে যায়।

নিত্যপণ্যের বাজারে চলমান অস্থিরতা দূর করতে সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সত্যিকারের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারগুলো সরকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

সরকারের একতরফা ব্যবসায়ী তোষণ নীতির কারণে ভোক্তা অধিকার বা বর্তমানে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থরিতার মতো অতি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে প্রশাসনের অগ্রাধিকার না থাকায় তারা সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে কার্যকর উদ্যোগ নিতে আগ্রহী নন। ফলে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার, সংবিধানে উল্লেখিত নাগরিক অধিকারগুলো সমুন্নত রাখার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

ইতিপূর্বে যেকোনো পণ্যের দাম বাড়লে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে বাণিজ্য, খাদ্যসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসন ঐ খাতের, উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা এবং প্রশাসনের লোকজনকে নিয়ে করণীয় পরামর্শ সভা করে বিকল্প উৎস থেকে আমদানি করা, বাজার তদারকি জোরদার, মজুতদারি ঠেকানো, বিকল্প বাজার হিসেবে খাদ্য ও টিসিবির ট্রাক সেল চালুর উদ্যোগ নিতেন। এখন টিসিবির ট্রাক সেল চলমান থাকলেও ক্রেতাদের দীর্ঘসারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

আমরা ব্যবসায়ীদের দেশাত্মবোধ ও মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারি। সরকারের দায়িত্বশীল লোকজনের দায়িত্ব পালন কতটুকু হচ্ছে, সে বিষয়টিও আলোচনায় আনতে হবে। শুধুমাত্র সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অনুশাসন আসলেই নড়েচড়ে বসবেন, তাহলে কি দায়িত্ব পালন হচ্ছে?

সরকারের মূল কাজ হলো, রেগুলেটরি অবস্থান। ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের জন্য সম্মানজনক সহবস্থান ও পরিবেশ তৈরি, নীতি সহায়তা দেওয়াই মূল কাজ। সেখানে কোনো জায়গায় কোনো পক্ষের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগভাজন হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

ব্যবসায়ী অতি মুনাফা লাভ করতে চাইবেন, এটা তার চিরাচরিত চর্চা। কিন্তু নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকার যদি সেখানে সঠিক দায়িত্ব পালন না করে তাহলে অস্থিরতা তৈরি হবেই।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ নেতা এফবিসিআই সভাপতিও বলেছেন, ব্যবসায়ীরা চাইলেই সরকারকে সব দাবি পূরণ করতে হবে, তা যথাযথ নয়। তাই নিত্যপণ্যের বাজারে চলমান অস্থিরতা দূর করতে সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সত্যিকারের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বাজারে ন্যায্য ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বাজার তদারকিতে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত বাজার তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর নীতি নির্ধারণে ভোক্তাদের সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ভোক্তাদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে।

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)