আবারও বাড়ছে বিদ্যুতের দাম, যৌক্তিকতা নেই- বলছে ক্যাব

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: ভর্তুকি কমাতে ভোক্তা পর্যায়ে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। আসন্ন ঈদের পরে একবার এবং জুলাই মাসের মধ্যে আরও একবার ৫ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে। এবিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

তবে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় জনগণের উপর বিরূপ চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এ দাম বাড়ানোয় ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে এ বছর প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করছে সরকার। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত সরকারের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কিন্তু অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

এ ছাড়াও নির্বাহী আদেশে এক দফা বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। গত ১৭ জানুয়ারি শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত, যা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কার্যকর করা হয়েছে।

গণমাধ্যমের তথ্য মতে, বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পেছনে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ। তাদের পরামর্শ হচ্ছে- জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংস্কার করা। সংস্কার বলতে বোঝানো হচ্ছে- ভর্তুকি কমানো। আর ভর্তুকি কমাতে হলে দাম বাড়াতেই হবে। এরপর থেকে সমন্বয়ের নামে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের মূল্য।

তথ্যে বলা হয়েছে, আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী ভর্তুকি কমাতে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাই ধাপে ধাপে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এপ্রিলে দাম বাড়ানোর ভাবনা থাকলেও রমজান মাস বিবেচনায় নিয়ে তা করা হচ্ছে না। তবে রমজানের পরই গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হবে। আর জুলাই মাসের মধ্যে আরও একবার বাড়ানো হবে। পাইকারিতেও বাড়ানো হতে পারে এ বিদ্যুতের মূল্য।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য মতে, গত দুই বছর ধরে দেশে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। আর এতে ঘাটতি বাড়ছে গড় উৎপাদন ব্যয় ও বিদ্যুতের দামে।

পিডিবির তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছর প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়ায় ৯ টাকা ৪৪ পয়সা। যদিও ওই সময় বাল্ক মূল্যহার ছিল ৫ টাকা ৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির লোকসান ছিল ৪ টাকা ৩৫ পয়সা। প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য চলতি অর্থবছর দাঁড়াবে ১১ টাকা ৫৪ পয়সা। দুই দফা বৃদ্ধির পর বর্তমানে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে ৪ টাকা ৮৪ পয়সা। আর আগামী অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য আগামী অর্থবছরে দাঁড়াবে ১১ টাকা ৮৫ পয়সা। বর্তমান বাল্ক মূল্যহার (৬ টাকা ৭০ পয়সা) বিবেচনায় প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াবে ৫ টাকা ১৫ পয়সা।

তথ্য আরও বলছে, চলতি অর্থবছরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য দাঁড়াবে ১৪ টাকা ৬ পয়সা। আর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম তিন দফা বাড়ানোর পর বর্তমানে গড় মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। এতে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে লোকসান গুনবে ৫ টাকা ৮১ পয়সা।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকার আর কোনো ভর্তুকি দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেছেন, ‘জ্বালানি খাতে যতটা খরচ হচ্ছে, ভোক্তার কাছ থেকে ততটা অর্থই নেওয়া হবে। প্রতিমাসে এটা সমন্বয় করা হবে।’

এর আগে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিস (এফবিসিসিআই) আয়োজিত বাংলাদেশ বিজনেস সামিট-২০২৩-এর একটি সেমিনারে নসরুল হামিদ বলেন, ‘বৈশ্বিক সংকটের সময়ে জ্বালানি খাতের ভবিষ্যৎ একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশের দেশ ভারত যে দামে জ্বালানি কিনছে, সে দামেই বিক্রি করছে। সরকার এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আর কোনো ভর্তুকি দেওয়া হবে না। জ্বালানি খাতে যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে, ভোক্তার কাছ থেকে সে পরিমাণ অর্থই নেওয়া হবে।’

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, বিতরণ সংস্থাগুলো পিডিবির কাছ থেকে পাইকারিতে কিনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। এখন পাইকারির দাম যে হারে বাড়ছে সেই হারে খুচরা পর্যায়ের দাম না বাড়ানো হলে লোকসান হবেই। তাই দাম আরও বাড়ানোর বিকল্প নেই। তাদের এখনও লোকসান হচ্ছে। আরও কমপক্ষে ৬-৭ শতাংশ দাম বাড়ানো হলে তাদের লোকসান হবে না। এটি সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী বলেন, আগে পাইকারিতে প্রায় ১৯ শতাংশ ও ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আর খুচরায় মোট ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটি দিয়ে আমাদের হবে না, আরও বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় এবং বাল্ক ট্যারিফের মধ্যে একটা বড় গ্যাপ রয়েছে। আবার বাল্ক ট্যারিফ যতটুকু বাড়ানো হয়েছে, খুচরা ততটুকু বাড়েনি। এখনও বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রায় ৫ শতাংশ গ্যাপে রয়েছে। দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা রয়েছে। সেই ৫ শতাংশ যেকোনো সময় বাড়তে পারে। তিনি বলেন, দাম বাড়ানো হবে, তবে রমজান মাসে গ্রাহকদের কষ্টের কথা চিন্তা করে সরকার এই সময়টায় দাম নাও বাড়াতে পারে।

তবে অধ্যাপক শামসুল আলমের মতে, ঘাটতি পূরণের জন্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন যৌক্তিকতা নেই- এই বিষয়টি আমরা বিইআরসির গণশুনানিতে জানিয়েছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর অভ্যন্তরীন এডজাস্টমেন্টের মাধ্যমেই এ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু সরকার সেটা না করে বিইআরসি আইনকে অকার্যকর করে দিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দাম বাড়াচ্ছে। এ মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তা স্বার্থ পরিপন্থী এবং লুন্ঠনমূলক একটি ব্যবস্থা। এই আইনের মাধ্যমে ভোক্তা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং সেই সাথে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো জবাবদিহিতার বাহিরে থাকছে।

একই কথা বলেন তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ। ভোক্তাকণ্ঠকে তিনি বলেন, বিইআরসির মাধ্যমে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময়েও মন্ত্রণালয়ের প্রভাব থাকতো। তবে সেই আইন অকার্যকর করে বর্তমানে সম্পূর্ণরুপে যেমন খুশি তেমন ভাবে দাম বাড়াচ্ছে সরকার। আর এতে জণগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।