কৃত্রিম সংকটে ভোক্তার পকেট কাঁটছে এলপিজি ব্যবসায়ীরা

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: রাজধানীসহ সারাদেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সরবরাহে কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকার বাজার থেকে এলপিজি গ্যাস উধাও হয়ে গেছে। এলপিজির সংকটকে পুঁজি করে দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। এছাড়া আসন্ন রমজানে দাম আরও বাড়াতে ব্যবসায়ীরা বাজারে এই সংকট সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন ভোক্তারা।

এদিকে কিছু এলাকায় এলপিজি গ্যাস পাওয়া গেলও সরকার ঘোষিত নির্ধারিত দামের চেয়েও ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছেন বিক্রেতারা। ১২ কেজি গ্যাসের একটি সিলিন্ডার তারা বিক্রি করছেন এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায়। ৩৫ কেজির এলপিজি গ্যাস বিক্রি করছেন চার হাজার ৮০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকায়।

দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বাণিজ্যিকভাবে প্রথম এলপি গ্যাস বাজারে আনে বসুন্ধরা গ্রুপ।বর্তমানে বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, যমুনা, ক্লিনহিট, টোটাল, ওরিয়ন, ওমেরা, লাফার্স, জি-গ্যাস, ডেলটা ও নাভানাসহ ১৮টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সারা দেশে এলপিজি সিলিন্ডার বাজারজাত করছে। ১২ কেজি, ৩০ কেজি, ৪৫ কেজিসহ বিভিন্ন ওজনের সিলিন্ডার বিক্রি হয়। বাসাবাড়িতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ১২ কেজির সিলিন্ডার।

গত বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) ১২ কেজির এলপিজির দাম ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। একসঙ্গে আড়াইশ টাকার বেশি দাম বাড়ানোয় এমনিতেই ক্রেতাদের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। তারওপর এখন সরকার নির্ধারিত দামেও গ্যাস পাচ্ছেন না ক্রেতারা। ১৪৯৮ টাকার গ্যাস খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করা হচ্ছে ১৮০০ টাকা। কোথাও কোথাও আরও বেশি। অর্থাৎ ৩শ টাকারও বেশি নেওয়া হচ্ছে ১২ কেজির সিলিন্ডারে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মগবাজার, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, লালবাগ, বাসাবো, মালিবাগ, খিলগাঁও এলাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে জানা গেছে, পরিবেশক ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে দু-একটি কোম্পানির বাইরে কোন এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার নেই। আগে যেখানে তারা ছয়-সাতটি কোম্পানির এলপিজি গ্যাস রাখতেন, এখন তারা দু-তিনটি কোম্পানির কাছ থেকে সিলিন্ডার গ্যাস পাচ্ছেন। 

রাজধানীর কমলাপুর এলাকার বন্ধন এন্টারপ্রাইজ থেকে বলা হয়, লিকুইড সংকটের কারণে চলতি মাস জুড়েই গ্যাসের সরবরাহ কমিয়েছে কোম্পানিগুলো। মাসের শেষে এসে তা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে।

তবে ভোক্তাদের অভিযোগ, দাম বাড়ানোর জন্য গ্যাসের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে ব্যবসায়ীরা। আর এই সংকটকে পুঁজি করে গ্যাসের দাম নিজেদের মতো করে বাড়াচ্ছেন বিক্রেতারা। গত মাসে ১২ কেজি গ্যাসের সিলিন্ডারের বিইআরসি নির্ধারিত দাম ছিল এক হাজার ২৩২ টাকা। কিন্তু ওই সময় এক হাজার ৪৫০ থেকে দেড় হাজার টাকায় গ্যাস কিনতে হয়েছে। আবার বর্তমানে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে বাজারে বেশির ভাগ এলপিজি কোম্পানির গ্যাস না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এলপিজি অপারেটররা। তারা বলছেন, এলপিজির কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে না পারায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ঋণপত্র জটিলতা না কমলে আসন্ন রমজানে পরিস্থিতি আরও তীব্র হতে পারে।

এ বিষয়ে বসুন্ধরা এলপিজি গ্যাসের চিফ অপারেটিং অফিসার (ব্র্যান্ড অ্যান্ড মার্কেটিং) এম এম জসিম উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাজারে এলপিজি গ্যাসের সংকট চলছে এটা সত্য। কারণ এলসি খুলতে না পারায় কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। বসুন্ধরার সেলস ভলিউম এরই মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশ কমে গেছে। এলসি সহযোগিতা না পেলে সামনে এ পরিস্থিতি আরো তীব্র হতে পারে।’

২০১৯ সাল থেকে দেশে নতুন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এতে রাজধানীসহ দেশের বড় একটি অংশের মানুষ এলপিজি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। দিন দিন বড় হচ্ছে এলপিজি গ্যাসের বাজার। বর্তমানে দেশে এলপিজির গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ভোক্তা পর্যায়ে এই গ্যাসের দাম বেড়েই চলেছে।

এ বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার এলপিজি গ্যাসের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার থেকে বেশি নেওয়া দণ্ডণীয় অপরাধ। গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম নিলে আইন অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। কেউ নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে গ্যাস কিনলে সরাসরি বিইআরসিতে অথবা জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারবেন।’

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘এলপিজি গ্যাসের দাম বেশি নেওয়ার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদেশে আমাদের অভিযান চলছে। গত বৃহস্পতিবার সারাদেশে অভিযান চলেছে। রোববারও সারাদেশে ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়েছেন। দাম বেশি নেওয়ার প্রমাণ পেলে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

 উল্লেখ্য, এলপিজি মূলত একটি আমদানিনির্ভর পণ্য। এটি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এ দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এটি সৌদি কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি।