জ্বালানি সংকটে বাড়ছে দুশ্চিন্তা

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: লোডশেডিং থেকে মুক্তি বিদ্যুৎ পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে গ্রাহকদের। বর্তমান লোডশেডিং পরিস্থিতি শিগগিরই কাটছে না। গ্যাস সংকটের কারণে কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। দাম বেশি হওয়ার কারণে স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি গ্যাস কেনা বন্ধ রেখেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। সবমিলিয়ে বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিত লোডশেডিং, বেড়েছে শিল্প খাতে গ্যাসের সংকট। যার কারণেই বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শিল্প কারখানার মালিকরা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়। এখন তা বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত, যা গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। কোথাও কোথাও দিনে পাঁচ বারও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণেই এই লোডশেডিং করা হচ্ছে।

অন্যদিকে জ্বালানি বিভাগ বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে স্পর্ট মার্কেটে বর্তমানে এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) চড়া দামের কারণে গ্যাস আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পাওয়া গ্যাস এবং কাতার-ওমান থেকে দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজি দিয়েই দেশের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। যার কারণে দেশে বর্তমানে ১০ শতাংশের মতো গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। আর এ জন্যই গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটছে।

এদিকে, জ্বালানি সংকটে শিল্প খাতের দৈন্যতার কথা তুলে ধরেছেন উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে কম উৎপাদন করতে হচ্ছে এবং বেশি ব্যয় হচ্ছে। এ সংকটে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে কমছে রপ্তানি। ক্রমাগত লোকসানের মুখে বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় আছে অনেক শিল্প কারখানা। বেকার হতে বসেছেন লাখো শ্রমিক। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে বেকায়দায় পড়েছেন মালিকরা।

রোববার এক আলোচনা সভায় শিল্পের বর্তমান এমন পরিস্থিতি তুলে ধরেন উদ্যোক্তারা। সংকট সমাধানে দ্রুততম সময়ে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে সরকারের প্রতি তারা অনুরোধ জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে গ্যাসের বেশি দর দিতেও তারা রাজি। পাশাপাশি অনুৎপাদনশীল কিংবা কম উৎপাদনশীল খাতে সরবরাহ কমিয়ে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে বলেছেন তারা।

রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে ‘শিল্প খাতে জ্বালানি সংকটের প্রভাব প্রশমন’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই)। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।

উদ্যোক্তাদের অনুরোধের জবাবে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা ও অনিশ্চিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা ঝুঁকিপূর্ণ। ২৫ ডলার (প্রতি এমএমবিটিইউ) হিসাব ধরে এলএনজি আমদানি করলেও চাহিদা মেটাতে অন্তত ছয় মাস কেনার মতো অবস্থা নেই। এ মুহূর্তে সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে আপাতত সংকট কিছুটা প্রশমনে প্রয়োজনে শিল্প মালিকরা সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস নিতে পারেন।’

সংকটের স্বল্পমেয়াদী সমাধান হিসেবে ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আগামী দু-তিন মাসের মধ্যেই ভোলা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিএনজি আকারে জাহাজে এনে জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হবে। এছাড়া আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কয়লাভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে শিল্পে কিছু গ্যাস দেওয়া যেতে পারে। তবে এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস না দিলে লোডশেডিং বাড়বে।’

তিনি মনে করেন, এসিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারের মাধ্যমে দুই-তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে। সে রকম হলে কিছু গ্যাস শিল্পে দেওয়া যাবে। প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার শপথ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান উপদেষ্টা।

এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘তাঁর নিজের কারখানায় সাত থেকে আট ঘণ্টা গ্যাস থাকে না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বিদ্যুতের লোডশেডিং আরও বেড়েছে। এসব কারণে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে রেশনিং সিস্টেমে যেতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। সংকটকালে তেল ও ফার্নেস অয়েলের ওপর গড়ে ২৪ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাই। 

তিনি বলেন, ‘স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি করে শিল্পে সরবরাহ করা হলে বেশি মূল্য দিতেও রাজি আছেন তারা।’

ব্যবসায়ীদের মুখপাত্র হিসেবে এসব প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরতে জ্বালানি উপদেষ্টার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি এবং হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, ‘গ্যাস সংকটে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। একদিকে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ, অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার চাপ রয়েছে। কারখানা আংশিক বন্ধ হবে, না কি স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে, না কি শ্রমিক ছাঁটাই করা হবে- সে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন তারা।’

সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মাত্র পাঁচ শতাংশ অতিরিক্ত গ্যাস পেলে শিল্প খাত টিকে যাবে। গ্যাসের অভাবে যাতে একটা কারখানাও বন্ধ না হয়। কোন শ্রমিক যাতে চাকরি না হারায়। না খেয়ে যেন কাউকে থাকতে না হয়।’

তৈরি পোশাকের রপ্তানি পরিস্থিতি প্রসঙ্গে এ. কে. আজাদ বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ কমে আসার পর চীন-ভিয়েতনাম থেকে ক্রেতারা রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। সে সুযোগে রপ্তানি বাড়ছিল। এখন রপ্তানি কমে যাচ্ছে।’

বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিটিএমএ’র সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে এক মিটার কাপড় উৎপাদনে খরচ ছিল ৫০ সেন্টের মতো। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে এখন তা ১ ডলার ৬০ সেন্টে দাঁড়িয়েছে। একদিকে উৎপাদনে লোকসান, অন্যদিকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চাপ। হাত-পা বেঁধে দিয়ে সাঁতার দেওয়ার মতো দশা।’

তিনি বলেন, ‘এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে কিনে গ্যাসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করা সম্ভব। তারা গ্যাসের বাড়তি দাম দিতে রাজি আছেন। এ বাবদ ব্যয় বাড়লেও রপ্তানি আয় দিয়ে পোষানো যাবে।’

বিআইডিএস’র মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘জ্বালানি সংকটে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কীভাবে কাজ করছে, তা জানা দরকার। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো আরও কয়েকটি কেন্দ্র নির্মাণ করা যায়। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে। শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৪৫ লাখের মতো মানুষের কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি খুব ভালো ভাবেই বিবেচনায় নিতে হবে। একইসঙ্গে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবতে হবে। বোরো ধান, গমের নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হবে। এ জন্য সারের নিরাপত্তা দরকার। অন্য খাতে রেশনিং করে হলেও এসব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’

বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, ‘শিল্পে দিনে গ্যাস প্রয়োজন ৯০ কোটি ঘনফুট। দেওয়া হচ্ছে ৫০ কোটি ঘনফুট। গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের কারখানায় গ্যাস সংকট সবচেয়ে বেশি। স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ নিয়ে এসব এলাকার কারখানায় গ্যাস দেওয়া জরুরি। অন্য খাত থেকে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হারে গ্যাস রেশনিং করে হলেও এই চার এলাকার শিল্পের চাহিদা মেটানো প্রয়োজন। আগামী তিন থেকে ছয় মাসের জন্য সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ অর্ধেক কমিয়ে এবং গ্যাসের অপচয় ১০ শতাংশ কমিয়ে আনলে দিনে ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস এই চার এলাকার শিল্পে দেওয়া সম্ভব।’

দ্রুত স্পট মার্কেট থেকে ২০০ থেকে ৪০০ এমএমসিএফডি গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘৩০ ডলার দরে প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাস কিনলে গ্রাহক পর্যায়ে মিশ্রিত (দেশীয় ও এলএনজি) গ্যাসের দাম ২৮ টাকার মতো পড়তে পারে।’

এমসিসিআই’র সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে স্থানীয় কিংবা রপ্তানি উভয় বাজারের জন্য উৎপাদিত পণ্যের ব্যয় বেড়েছে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অথচ প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম কিংবা ভারতে এ সংকট নেই।’

তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট সমাধান না হলে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।’

বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি আকতার হোসেন অপূর্ব বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমেছে। এ কারণে অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে পাঁচ শতাংশ। এর প্রভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘সিএনজি স্টেশন থেকে নিরাপত্তার সঙ্গে কারখানায় গ্যাস নিতে চান তারা। এলপিজি ব্যবহারের উপযোগী অবকাঠামো নির্মাণে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া দরকার।’

ফার্নেস অয়েলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিও জানান তিনি।

বাংলাদেশের পোশাকের বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের বাংলাদেশ ও ভারতের কান্ট্রি ডিরেক্টর স্বপ্না ভৌমিক বলেন, ‘বাংলাদেশের যেসব কারখানা থেকে তাঁরা পোশাক নেন, এ রকম ২৭টি কারখানায় সরেজমিনে গেছেন তিনি। যে অভিজ্ঞতা তিনি পেয়েছেন, তা রীতিমতো ভয়ের। উৎপাদন কম হচ্ছে। অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে পণ্যের চাহিদা কমছে। তুলার বেশি দরের কারণে পণ্যের দর বাড়ানো দরকার। অথচ দর বাড়ালে রপ্তানি কমে যাচ্ছে। যেভাবে হোক শিল্পে গ্যাস সংকটের দ্রুত সমাধান করতে হবে।’

একইসঙ্গে উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা।’

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রোববার দিনের বেলায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে নয় হাজার ৮১৭ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ১১ হাজার ৯৩৯ মেগাওয়াট। তবে দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য দৈনিক প্রয়োজন ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। গত ১২ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৪২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো)।