বাড়তে পারে বিদ্যুতের দাম, কৌশলগত অবস্থানে বিতরণ কোম্পানি

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঝাঁজ শেষ না হতেই আবারও বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। আগামী সপ্তাহে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়তে পারে বিদ্যুতের পাইকারী দর। তবে খুচরা পর্যায়ে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত না হলেও ভোক্তার উপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

অন্যদিকে, কতটা দাম বাড়ে তার উপর বিবেচনা করে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো।

তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মতে, দাম বাড়ানোর আবেদনের বিষয়ে যৌক্তিকতা দেখাতে পারবে না বিতরণ সংস্থা। কারণ পাইকারী পর্যায়ে দাম বাড়ানোর পরও বিতরণ কোম্পানি লাভে থাকবে।

লোকসানের কথা উল্লেখ করে ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৫৮ টাকা করার আবেদন করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো)। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দর ৫.১৭ টাকা নির্ধারণ করে বিইআরসি। যা তার আগে ছিল ৪.৭৭ টাকা। এ দাম পরের মাসের ০১ তারিখ থেকে কার্যকর করা হয়।

তখন গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫.৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৭.১৩ পয়সা করা হয়। যা আগে ছিল প্রতি ইউনিট ৬.৭৭ পয়সা। এছাড়াও বিদ্যুৎ সঞ্চালন মূল্যহার বা হুইলিং চার্জ প্রতি ইউনিটে ০.২৭৮৭ টাকা থেকে ৫.৩ শতাংশ বাড়িয়ে ০.২৯৩৪ টাকা করা হয়।

তবে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রয় দর নির্ধারণের জন্য বিউবো এবং বিতরণ সংস্থাগুলো সাধারণত একই সময়ে আবেদন করে থাকে৷ কিন্তু এবার বিউবো আবেদন করলেও বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর বিষয়ে এখনো আবেদন করেনি বলে জানিয়েছে বিইআরসি। 

এছাড়াও, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে নির্দেশনা দিলেও বিতরণ সংস্থা খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন করেনি। বিতরণ সংস্থা আবেদন করবে- এমন ধারণায় বিইআরসি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছে বলেও জানিয়েছেন বিইআরসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা।

বিইআরসি আইন অনুযায়ী, গণশুনানির পর ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে আদেশ দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গত ১৮ মে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়, সে হিসেবে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত হাতে সময় রয়েছে বলে জানিয়েছে বিইআরসি কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে বিইআরসি সদস্য (অর্থ) আবু ফারুক ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘দাম বাড়ানোর বিষয়ে আমরা শেষ পর্যায়ে এসেছি, আগামী ১০ দিনের মধ্যেই এই ঘোষণা দিতে পারবো। তবে কতটা বাড়বে সে বিষয়ে কমিশন ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের সময়সীমা নির্ধারণ করা আছে। আমরা সেই সময়ের মধ্যেই ঘোষণা করতে চাই।’

বিউবো বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা। বিউবোর অধীনস্থ বিতরণকারী পাঁচ কোম্পানী হলো- ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিসিটি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)।

এছাড়াও, বিতরণ কোম্পানির কাছে পাইকারি দরে বিক্রির পাশাপাশি বিউবো নিজে ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের শহরাঞ্চলসহ অন্যান্য কিছু অঞ্চলে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণ করছে।

আবু ফারুক বলেন, ‘আমরা শুধু পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর বিষয়ে আবেদন পেয়েছি, অন্যান্য পর্যায়ে বাড়ানোর বিষয়ে আবেদন পাইনি। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত খুচরা পর্যায়ে দাম না বাড়বে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে কোন (নেতিবাচক) প্রভাব পড়বেনা।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে বিতরণ কোম্পানিগুলো যদি মনে করে, যে দাম বেড়েছে সেই দাম তারা (কোম্পানি)  মোকাবিলা করতে পারবে। তাহলে তারা খুচরা দাম বাড়ানোর বিষয়ে আবেদন করতে নাও পারে। আর যদি তাদের লোকসান হয়, তাহলে তারা আবেদন করতে পারে। তবে সবকিছুর মূলে রয়েছে- পাইকারি দাম বাড়বে কি-না বা কতটা বাড়বে।’

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘দাম বাড়ানোর জন্যে শুধু আবেদন করলেই হবে না। এখানে তাদের (কোম্পানি) আবেদনের যৌক্তিকতা থাকতে হবে। তাদের প্রমাণ করতে হবে- দাম বাড়ানোর কারণে তাদের লোকসান হচ্ছে। তাই তাদের জন্যও দাম বাড়ানোর দরকার।’

তবে বিতরণ কোম্পানিগুলোর হিসাব তথ্য অনুযায়ী বিইআরসি বিশ্বাস করে- তারা লাভে আছে এবং পাইকারির নতুন যে দাম নির্ধারণ করা হবে, সেই দামেও তারা লাভে থাকবে। তাই তারা আবেদনের যৌক্তিকতা দেখাতে পারবেনা।

তবে তার এ কথায় একমত হতে পারেননি বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসি’র কর্মকর্তা (অপারেশন) আরিফুল আহসান। তিনি ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘বিতরণ কোম্পানিগুলো সরকারের স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে দাম নির্ধারণের বিষয়ে সরকারের প্রাধান্য থাকে। পাইকারি দামের সঙ্গে বিতরণ কোম্পানির খরচ যোগ করে খুচরা দাম নির্ধারণ করা হয়। এখানে পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়লে, খুচরা পর্যায়ে না বাড়িয়ে চলবে- এমন নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাইকারি দাম বাড়লে অবশ্যই খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। তবে যদি সেটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে, যেটা আমরা না বাড়িয়েও মোকাবিলা করতে পারবো, তাহলে এই মুহূর্তে আবেদন নাও করতে পারে। কারণ সেটা নির্ভর করছে কতটা বাড়ে। তবে বাড়ানোর জন্য আবেদনের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’

কতটা বাড়লে আবেদন করা হবে- এমন প্রশ্নে কৌশলতা অবলম্বন করে আরিফুল আহসান বলেন, ‘সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। কারণ এখানে টেকনিক্যাল অনেক হিসাব নিকাশের বিষয় রয়েছে। এখানে যাই করা হোক সেটা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। কারণ আমরা তো বিউবোরই প্রতিষ্ঠান।’

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ও ডেসকো’র পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। 

গত ০৫ অগাস্ট ভোক্তা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। তবে ২৯ অগাস্ট লিটারে পাঁচ টাকা কমানো হয়।

পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর জন্য জ্বালানির দাম বাড়ার কারণকে প্রধান হিসাবে দেখা হবে। বিশেষত ডিজেল এবং ফার্নেস অয়েলের দামের উপর নির্ভর করেই বিদ্যুতের নতুন দাম নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন বিইআরসি’র কর্মকর্তারা। 

এদিকে, বিউবোর পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চাহিদা মতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়।

বিউবোর মতে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মুসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে।

তবে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম মনে করেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। কারণ উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার কারণে যেখানে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রেখে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে, সেখানে দাম বাড়ানোর কোন যৌক্তিকতা নেই।

তিনি বলেন, ‘সাত শতাংশ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ধরে গণশুনানি করা হয়েছিল। এখন সেখানে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি না রেখে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ উৎপাদন কমানো হচ্ছে এবং প্রচন্ড লোডশেডিংয়ের মধ্যে রয়েছে দেশ।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে লোডশেডিং দিয়ে জ্বালানি সেভ করা হচ্ছে, ব্যয় কমানো হচ্ছে। সেখানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোন যৌক্তিকতা নেই। এটা অযৌক্তিক, অন্যায় এবং বিইআরসির আইন পরিপন্থী।’

পাইকারি দাম বাড়লে পরোক্ষ ভাবে ভোক্তাদের উপর প্রভাব পড়বে কি-না- এমন প্রশ্নে অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘অবশ্যই ভোক্তা পর্যায়ে অবশ্যই প্রভাব পড়বে। কারণ দিন শেষে এই ঘাটতি ভোক্তার উপর থেকেই তোলা হবে। সুতরাং বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অযৌক্তিক হবে।’

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালের ০১ মে রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে সাবেক ওয়াপদা থেকে পৃথক হয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আলোকিত ও শিল্পায়িত করার দায়িত্ব নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সমন্বিত সংস্থা হিসেবে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিউবো। পরবর্তীতে বিউবো’র বিদ্যুৎ সঞ্চালন, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার পূর্ণ বা অংশবিশেষ অধীনস্থ অন্য কোম্পানিগুলোর কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে দেশে ২২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। এর বিপরীতে চাহিদা ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট।