ভুল নীতির মাশুল বিদ্যুতে

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন ১৫৩টি। এর মধ্যে গত ১৫ বছরে বর্তমান সরকারের আমলেই নির্মাণ করা হয়েছে ১২৬টি কেন্দ্র। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু কারিগরি ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং জ্বালানি সংকটের ফলে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে এবং অনেকগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে এই মুহূর্তে সক্ষমতার অর্ধেকও উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

উৎপাদন কমে যাওয়ায় সম্প্রতি ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হয় সারা দেশ। রাজধানী ঢাকায় কিছুটা কমে এলেও গ্রামে এখনো লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতের করুণ দশার জন্য দায়ী সরকারের ভুল নীতি ও পরিকল্পনা। তারা বলছেন, দেশি উৎস গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর দিকে জোর না দিয়ে সরকার অতিরিক্ত আমদানি-নির্ভর হয়ে উঠেছে। বিদেশে সংকট তৈরি হওয়ায় এখন আমাদের বিকল্প থাকছে না।

রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সবশেষ তথ্যে দেখা গেছে, দেশের মোট ১৫৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে কারিগরি ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণ কাজ এবং জ্বালানি সংকটের কারণে সম্পূর্ণ রূপে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে।

এগুলোর মধ্যে তিনটি বন্ধ আছে কারিগরি ত্রুটির কারণে। এ তিনটি হলো- মদনাগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট (ফার্নেস), ঘোড়াশাল ৩৬৫ মেগাওয়াট (গ্যাস), কাটাখালি ৫০ মেগাওয়াট (ফার্নেস-কুইক রেন্টাল)।

রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলার কারণে বন্ধ আছে ১১টি কেন্দ্র। এগুলো হলো- ঘোড়াশাল রিপাওয়ারড ২৬০ মেগাওয়াট (গ্যাস), হরিপুর ৩২ মেগাওয়াট জিটিপিপি (গ্যাস), সিদ্ধিরগঞ্জ ২১০ মেগাওয়াট (গ্যাস), চট্টগ্রাম ২১০ মেগাওয়াট টিপিপি ২ (গ্যাস), শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং জিটি (গ্যাস), আশুগঞ্জ, ৪২০ মেগাওয়াট সিসিপিপি পূর্ব (গ্যাস), চাঁদপুর ১৫০ মেগাওয়াট (গ্যাস), সাজিবাজার ৩৩০ মেগাওয়াট (গ্যাস), সাজিবাজার ১০০ মেগাওয়াট (গ্যাস), ভোলা নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র ২২০ মেগাওয়াট (গ্যাস), বড়পুকুরিয়া ১২৫ মেগাওয়াট ইউনিট ২ (কয়লা)।

জ্বালানি সংকটের কারণে বন্ধ আছে ৮টি কেন্দ্র। সেগুলো হলো- চট্টগ্রাম ১০৮ মেগাওয়াট (ফার্নেস), কাটপট্টি ৫২ মেগাওয়াট (ফার্নেস), মধুমতি ১০০ মেগাওয়াট (ফার্নেস), বাঘাবাড়ী ৭১ মেগাওয়াট (গ্যাস)বাঘাবাড়ী ১১০ মেগাওয়াট (গ্যাস), সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট ইউনিট ২ (গ্যাস), বাঘাবাড়ী ২০০ মেগাওয়াট (ডিজেল), বড়পুকুরিয়া ১২৫ মেগাওয়াট ইউনিট ১ (কয়লা)।

চালু থাকা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে উৎপাদন স্বল্পতায় ভুগছে ৬৭টি কেন্দ্র। এর মধ্যে কারিগরি ত্রুটির কারণে কম উৎপাদন করতে হচ্ছে ২৯টি কেন্দ্রে। জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন কমে গেছে ৩৫টি কেন্দ্রের। আর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলার কারণে একটি কেন্দ্রে সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

বন্ধ থাকা এবং কম উৎপাদনের তালিকায় আছে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও।

কাটাখালি ৫০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কুইক রেন্টাল কেন্দ্র কারিগরি ত্রুটিতে বন্ধ রয়েছে। চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় ৪টি কুইক রেন্টাল উৎপাদনে নেই। কুইক রেন্টালের অধীনে কেবল একটি কেন্দ্র চালু রয়েছে। সেটি হলো ফার্নেস তেলভিত্তিক আনমুরা ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্র, যেটি এখন ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। উচ্চমূল্যের কারণে ডিজেলভিত্তিক রংপুর ২০ মেগাওয়াট, সৈয়দপুর ২০ মেগাওয়াট ও ভেড়ামারা ২০ মেগাওয়াট ইউনিট-৩ এর উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।

বন্ধ এবং উৎপাদন স্বল্পতায় থাকা কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১২ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে চালু থাকা কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট। বাকি ৫৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বর্তমানে গড়ে উৎপাদিত হচ্ছে ৮ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে ১২০০০-১২৫০০ মেগাওয়াট। এটি আমাদের চাহিদা মেটাতে পারছে না। প্রতিদিন গড় চাহিদা এখন ১৫-১৬ হাজার মেগাওয়াট। ফলে প্রতিদিনই কয়েক হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

এদিকে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪৭ শতাংশই গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের। গ্যাসভিত্তিক ৬৪টি কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পালাক্রমে বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। তার বিপরীতে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে ৩০০ কোটি ঘনফুট। কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ডলারের সংকট থাকায় গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান শেভরনকে নিয়মিত বিল পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাহত হচ্ছে এলএনজি আমদানিও।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব না দেয়ার ফলে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। ভোলার গ্যাসকূপ ছাড়া গত ২০ বছরে বড় আকারের কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করা হয়নি।

একই চিত্র কয়লা খাতেও। দেশে বর্তমানে পাঁচটি কয়লাখনি থাকলেও মাত্র একটি খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। যা দিয়ে বড়পুকুরিয়ার একটি ইউনিট চালানো হয়। ফলে দেশের বাকি ৪টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমদানি করা কয়লার ওপর নির্ভরশীল। চারটির মধ্যে তিনটিই কয়লা সংকটে রয়েছে। বাকি একটিতে উৎপাদন চলছে।

দেশে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৭৩টি। এর মধ্যে ৬৫টি ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক, ৮টি ডিজেল ভিত্তিক। তবে ডিজেলের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় গত বছরের জুলাই মাস থেকে ৮ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

৬৫টি ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক কেন্দ্রের অধিকাংশই এখন তেল সংকটে ভুগছে। এসব কেন্দ্রের বেশির ভাগই আইপিপি মালিকানাধীন।

বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা) জানায়, আইপিপি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পিডিবি কিনে থাকে।বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ পিডিবির কাছে তাদের পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ডলার সংকটের ফলে পিডিবি তাদের বিল পরিশোধ করতে পারছে না। বিল না পাওয়ায় ব্যাংকের দায় শোধ করা যাচ্ছে না এবং নতুন করে তেল আমদানির জন্য এলসিও খোলা যাচ্ছে না। ফলে হোঁচট খাচ্ছে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী বলেন, মেইনটেনেন্স-এর (রক্ষণাবেক্ষণ) জন্য বিভিন্ন সময়ে প্লান্টগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকে। এ ছাড়া দীর্ঘসময় ধরে উৎপাদনে থাকলে মেশিনে ত্রুটি দেখা দেয়। তবে এগুলো সাময়িক সমস্যা, দীর্ঘস্থায়ী নয়। আমরা উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, আমরা সবসময় বলে আসছি, গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারের জোর দেওয়া উচিৎ। কিন্তু তা না করে আমরা আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছি। আমদানি থেকে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলেই সংকট দেখা দেয়। তাই জ্বালানি আমদানির সঙ্গে সমান্তরালভাবে দেশের ভেতরের উৎস থেকেও সরবরাহ বাড়ানো উচিত।

সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।