স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কিনতে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক

দেশের জ্বালানি সংকট মেটাতে বেশি দাম দিয়ে হলেও স্পট মার্কেট (খোলা বাজার) থেকে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গ্যাসের চাহিদা পূরণে চলতি বছরে স্পট মার্কেট থেকে মোট ১৮ কার্গো এলএনজি আমদানি করবে পেট্রোবাংলা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৬ অক্টোবর স্পট মার্কেট থেকে আরও দুই কার্গো এলএনজি কেনার প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।

তবে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশকে এলএনজি কিনতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েই কিনতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে না তাকিয়ে থেকে নিজেদের উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের দিকে নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসাইন বলেন, স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশের এলএনজি কেনার কোনো প্রয়োজন নেই। যেসব দেশে, বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশগুলোতে পর্যাপ্ত জ্বালানি রয়েছে কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ খুব বেশি প্রয়োজন হয়, তারাই স্পট মার্কেট থেকে কিনবে। কিন্তু বাংলাদেশের তো সেই পরিস্থিতি নেই। আমাদের যেটা প্রয়োজন, আমরা তো সেটাই পাচ্ছি না। আমি বলতে চাই, দীর্ঘমেয়াদি যেসব চুক্তি হয়, সেখানেই থাকা ভালো। যদি কোনো কারণে বেশি প্রয়োজন হয়, তখন স্পট থেকে কেনা যাবে।

‘একটা সময় হয়তো স্পটে দাম খুব কম ছিল। তখন সরকারকে অনেকেই নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির চেয়ে আমরা স্পট থেকেই কম দামে কিনতে পারি। কিন্তু এখন দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেও স্পট থেকেই কিনতে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, আমরা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করছি না, তা তো নয়। কিন্তু বললেই তো আর হয়ে যায় না, সময় তো লাগবে। আমরা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি নিচ্ছি, আবার লং টার্মের প্রক্রিয়াও চলছে। স্পট থেকে না আনলে ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যেত। গত তিন মাসে ১১ শতাংশ রপ্তানি বাড়লো। আমরা যদি গ্যাস দিতে না পারতাম তাহলে এটা কীভাবে হতো? যারা সমালোচনা করেন, খুব সহজেই তারা বলে ফেলেন।

এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার ম্যাগাজিনের সম্পাদক মোল্লা আমজাদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, পেঁয়াজের যখন ২শ টাকা দাম হয় তখনও মানুষ কেনে। ঠিক এনার্জিও দরকার হলে কিনতেই হবে। আমাদের রাজনীতিবিদরা ও পরিকল্পনা যারা নেন তারা বলেন, জাপান, কোরিয়া এলএনজি আমদানি করতে পারে, আমরা কেন পারবো না। শুধু একথা বলেই ২০০০ সালের পর থেকে গত ২০ বছরে বাংলাদেশ তেল গ্যাস অনুসন্ধান করেনি। অন্যদিকে কয়লা উত্তোলনও করেনি। আমেরিকা কয়লা উত্তোলন করে, চীন উত্তোলন করে। কিন্তু আমরা সরে আসছি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের এনার্জি আমদানি ২০৪০ সাল থেকে শুরু করলেও চলতো। কিন্তু নিজস্ব গ্যাস, কয়লা উত্তোলন না করার কারণে আমদানি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে এলএনজি আমদানির ওপর চাপ পড়েছে। এটা নিয়ে এখনো পর্যন্ত সরকারের কোনো ভালো পরিকল্পনা নেই। হুট করে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম ৫ ডলারে নেমে গেলো। তখন মনে হলো, কেন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে কিনছি! এটা স্পট মার্কেটে অনেক কমেও পাওয়া যাচ্ছে।

জ্বালানি সচিব মো. আনিসুর রহমান আরো বলেন, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের যে গ্যাসের চাহিদা আছে, তা আমরা সরবরাহ করতে পারবো। শিল্পের প্রয়োজনে আমরা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আনতে বাধ্য হয়েছি। শুধু আমরা নই, আপনি সারা বিশ্বের দিকে তাকান। উন্নত বিশ্বও বিপর্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, আমাদের প্রতিবেশী ভারতের অবস্থাও দেখুন। সে তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি।

এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানির একটি প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময়ে প্রতি এমএমবিটিইউর দাম ছিল ২৯ দশমিক ৮৯ ডলার।

পেট্রোবাংলার সূত্রগুলো বলছে, এলএনজির দামে ঊর্ধ্বগতি থাকায় ডিসেম্বর পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে পণ্যটি না কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে। কিন্তু গ্যাসের ঘাটতি বিবেচনায় জ্বালানি বিভাগ সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

এরপর ১৪ দিনের ব্যবধানে আরও দুই কার্গো এলএনজি কেনার সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়, তখন প্রতি এমএমবিইউর দাম ৬ ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৯৫ ডলারে। এরই মধ্য দিয়ে চলতি মাসে ১ হাজার ৬১ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি হচ্ছে।

৬ অক্টোবর মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে এলএনজি কিনতে হচ্ছে। এ বছর আর না কিনলেও চলবে।

দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রতিদিন ৭৫-৮০ কোটি ঘনফুট এলএনজি প্রয়োজন। কিন্তু এর বিপরীতে দেশে এলএনজি সরবরাহের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ৩৫ কোটি ঘনফুটেরও বেশি। এই ঘাটতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।

জানা যায়, গ্যাসের চাহিদা পূরণে চলতি বছর স্পট মার্কেট থেকে ১৮ কার্গো এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে চলতি বছর মোট আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৬ এমএমবিটিইউ। এরই মধ্যে স্পট মার্কেট থেকে ১৪ কার্গো বা ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৮৫ হাজার ১৬৯ এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। বাকি চার কার্গোর মধ্যে বুধবার (৬ অক্টোবর) ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি দুই কার্গো এলএনজি আমদানির অনুমোদন দিয়েছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েই চলছে এলএনজির দাম। গত বছর প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়েছিল ৩ দশমিক ৮৩ ডলার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৬৭ লাখ ২০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি কেনার একটি প্রস্তাব দেয় জ্বালানি বিভাগ। ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির কাছে দেওয়া ওই প্রস্তাবে এলএনজির কার্গোতে ইউনিটপ্রতি দাম ধরা হয় ৯ দশমিক ৩১ ডলার এবং সপ্তম এলএলএনজি কার্গোতে ইউনিটপ্রতি দাম পড়ে ৯ দশমিক ৩৬ ডলার।

খবর: জাগো নিউজ