রাজধানীতে দিনের বেলায় জ্বলে না গ্যাসের চুলা

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশজুড়ে চরম আকার ধারণ করেছে গ্যাস সংকট। দিনের বেশির ভাগ সময় চুলায় থাকছে না পাইপলাইনের গ্যাস। এতে করে একদিকে গ্রাহকদের বাড়ছে ভোগান্তি, অপরদিকে বাড়ছে খরচ। প্রতি মাসে সরকারি সংযোগের বিল পরিশোধ করেও পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস মিলছে না, ফলে বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হচ্ছে সিলিন্ডার গ্যাস।

এবারের শীত মৌসুমের আগেই মূলত গ্যাসের সংকট শুরু হয়। দেশের দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি পরিচালনা করে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। বিগত ১ নভেম্বর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টার্মিনালটি বন্ধ হয়ে যায়। চুক্তি অনুযায়ী, সাধারণত পাঁচ বছর পর পর টার্মিনালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় যায়। এ দফায় মোট দুই মাস গ্যাস সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে এক্সিলারেটের টার্মিনালটি।

টার্মিনালটি বন্ধ হওয়ার পর গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ কমে যায়, যার দৈনিক পরিমাণ প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট। যা মোট চাহিদার প্রায় ৮ থেকে ৯ শতাংশ। কিন্তু এ পরিমাণ গ্যাস স্বল্পতার কারণে সামগ্রিক ভাবে চাপে পড়েছে গ্যাসখাতে, যার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন- প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাসের যথেষ্ট উৎপাদন নিশ্চিত না করতে পারা।

দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু বর্তমানে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে ২৫০ কোটি ঘনফুট, যা ২০২০ সালের পর সর্বনিম্ন। বিপুল পরিমাণ এ ঘাটতির প্রভাব দেখা যাচ্ছে শিল্প ও আবাসিক খাতে। বিশেষত আবাসিক পর্যায়ে গ্যাস সংকটের আকার ভয়াবহ। দিনের অধিকাংশ সময় চুলায় মিলছে না গ্যাসের দেখা, রান্নাবান্না করতে নির্ভর করতে হচ্ছে এলপি গ্যাসের ওপর।

বেসরকারি চাকরিজীবী আশিক মাহমুদ বসবাস করেন মোহাম্মদপুর এলাকায়। তিনি বলেন, দিনের বেলায় গ্যাসের কোনো নামগন্ধ থাকে না। রাত ১২টার পর থেকে চুলায় গ্যাসের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু এত রাতে তো আর রান্নাবান্না সম্ভব না, তাই বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হচ্ছে। লাইনের বিল তো দেওয়া লাগেই, এখন সিলিন্ডারের খরচও যুক্ত হয়েছে।

একই এলাকার আরেক বাসিন্দা পারভীন আক্তার। তিনি বলেন, দিনের বেলায় চুলায় কোনো গ্যাস পাওয়া যায় না। রান্নাবান্না সব সিলিন্ডার গ্যাসেই করতে হয়। বর্তমান বাজারে সিলিন্ডার গ্যাসের খরচ বহন করা একটা বাড়তি বোঝা ছাড়া কিছুই না।

বসিলায় বসবাস করেন গার্মেন্টস শ্রমিক হেলেনা বেগম। গ্যাস সংকটের ফলে তিনি বাধ্য হয়ে মাটির চুলা ব্যবহার করা শুরু করেছেন। হেলেনা বলেন, পাশাপাশি অনেকগুলো পরিবার একত্রে ভাড়া থাকি। কিন্তু চুলার সংখ্যা মাত্র দুইটা। যখন গ্যাস থাকে, তখন তো এমনিতেই চাপ থাকে। আর এখন তো গ্যাসই নেই। তাই মাটির চুলা কিনেই রান্নাবান্না করছি।

অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও ভোগান্তির কথা জানাচ্ছেন অনেকেই। শীতকালে সাধারণত বাসা-বাড়িতে গ্যাসের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু এবারে উল্টো গ্যাসের সরবরাহই কমে যাওয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ব্যবহারকারীরা।

গ্যাসের এই সংকট সহসা কেটে যাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অপরদিকে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় এলএনজি আমদানির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমান ডলার সংকট সে সমাধানকে অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। গত ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২৪ এ গবেষণায় অংশ নেওয়া ৭০টি বাংলাদেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতিকে অর্থনীতি ও তাদের ব্যবসার জন্য ১ নম্বর হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে।

তবে বন্ধ থাকা এলএনজি টার্মিনালটি চালু হলে গ্যাস সংকট কিছুটা কমবে বলে জানিয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) কামরুজ্জামান খান বলেন, কিছুদিনের মধ্যেই টার্মিনালটি চালু হবে। রক্ষণাবেক্ষণের ফলে আগের তুলনায় এখন আরও বেশি পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। এছাড়া দেশীয় খাত থেকেও আমরা উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টায় রয়েছি।

অপরদিকে, আগামী মার্চ মাসের মধ্যে চলমান গ্যাস সংকটের সমাধান হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দেশের দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি সংস্কারের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এ কারণে শীতে চলমান গ্যাস সংকট আরও বেড়েছে। এলএনজি টার্মিনালটি সংস্কার শেষে দেশে না আসা পর্যন্ত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো পেট্রোবাংলার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি বছরই শীতে পাইপলাইনে পানি জমার কারণে গ্যাসের সংকট সৃষ্টি হয়। এছাড়া এই সময়ে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় গ্যাসের চাহিদাও বেড়ে যায়। এবার সেই সংকটের সঙ্গে সরবরাহের অপ্রতুলতা যোগ হওয়ায় গ্যাস সংকট বেড়েছে।

তবে এলএনজি থেকে সরবরাহ বাড়লেও আবাসিক ও শিল্পে গ্যাসের ঘাটতির পরিমাণ কমবে না। কারণ সামনেই শুরু হচ্ছে সেচ মৌসুম। স্বাভাবিক ভাবে তখন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বাড়তি গ্যাস দিতে হবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলএনজি আমদানির পাশাপাশি দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন না বাড়ালে সংকট মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ আহমেদ বলেন, বর্তমানে গ্যাসের যে সংকট চলছে, এটা হওয়ারই কথা ছিল। কারণ আমরা গ্যাস আমদানির ওপর যতটা নজর দিয়েছি, উত্তোলনের প্রতি ততটা নজর দিইনি। আমাদের দেশে যথেষ্ট প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। সেসব উত্তোলনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে কেবল আমদানি নির্ভর এলএনজি দিয়ে গ্যাস সংকট দূর করা যাবে না। ঢাকা পোস্ট।