কাঁচা মরিচে স্বস্তি নেই, আইন প্রয়োগে ঘাটতি দেখছে ক্যাব

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: কাঁচা মরিচের মূল্য নিয়ে স্বস্তিতে নেই ভোক্তা। দেশে কাঁচা মরিচের আমদানি বাড়লেও বাজার এখনো উত্তপ্ত। রাজধানীসহ দেশের অনেক বাজারেই এখনও কাঁচা মরিচ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

ঈদের আগে ও পরে কাঁচা মরিচের যে দর, তা এখন আর নেই। তবে দাম স্থিতিশীলও হচ্ছে না। একদিন ১০০ টাকা বাড়ে তো পরের দিন কমে ১৫০ বা ২০০ টাকা।

অতি মুনাফা লোভী ব্যবসায়ী ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে আমদানির পরও কাঁচা মরিচের দাম কমছে না বলে মনে করছে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

ভারতে কাঁচা মরিচের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় আমদানির পরও দেশের বাজারে দাম কমছে না বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। এদিকে, বর্ষায় দেশি কাঁচা মরিচের ফলন কমে যাওয়ায় দেশি মরিচের দামও বেড়েছে।

ঈদের আগে লাগামহীন ভাবে কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধি পায়। ভারত থেকে আমদানি শুরুর আগে কোনো দিন ৫০০ কোনো দিন ৭০০, কোথাও এক হাজার এমনকি কেজিপ্রতি ১২০০ টাকা দরেও কাঁচা মরিচ বিক্রি হওয়ার খবর মিলেছে। পরে বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ২৫ জুন থেকে মরিচ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। আমদানি অব্যাহত থাকলেও দেশের বাজারে এখনও ঊর্ধ্বমুখী কাঁচা মরিচের দাম। আমদানি অব্যাহত থাকার পরও অস্বাভাবিক ভাবে মরিচের দাম ওঠানামা করায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের ঘাটতি ও উচ্চমূল্য ঠেকাতে ভারত থেকে এ পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৮৩০ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে এখন পর্যন্ত দেশে এসেছে প্রায় ৬৪৫ টন। এর মধ্যে বেনাপোল বন্দর দিয়ে গত পাঁচ দিনে ভারত থেকে এলো আমদানি করা ২১১ টন কাঁচা মরিচ। বাকিটা এসেছে হিলি এবং ভোমরা বন্দর হয়ে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘কাঁচা মরিচ আমদানিতে ১৪৮টি আইপির বিপরীতে ৫১ হাজার ৩৮০ মেট্রিক টন অনুমতি দেয়া হয়েছে।’

আমদানিকৃত কাঁচা মরিচের দর
কয়েকজন কাঁচা মরিচ আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতে কাঁচা মরিচের দাম নেওয়া হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ২০০ রুপি। কাঁচা মরিচ বাংলাদেশে আসার পর টনপ্রতি রাজস্ব নেওয়া হয় ৫০০ মার্কিন ডলার। সে হিসেবে ট্যাক্স পানামা খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজিতে খরচ হয় ৪০ টাকা। এরপর ট্রান্সপোর্ট খরচ প্রতি কেজিতে ১০ টাকা ধরে পাইকারি দাম নির্ধারণ করে আমদানিকারকরা।

কাঁচা মরিচ আমদানি করা প্রতিষ্ঠান বেনাপোলের মেসার্স ঊষা ট্রেডিং এর পক্ষ থেকে দায়িত্বরত কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান বাবু বলেন, আমদানি মূল্য, সরকারি রাজস্ব ও পরিবহন ব্যয় সবমিলিয়েও মরিচের দাম পড়ে যাচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। বাংলাদেশে কাঁচা মরিচের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও পর্যাপ্ত আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ভারতের মোকামেই মরিচের দাম ঊর্ধ্বমুখী।

তবে আমদানিকৃত ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা দরের কাঁচা মরিচ রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আমদানিকারক বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতি টন কাঁচা মরিচের ট্যারিফ মূল্য বেঁধে দিয়েছে ৫০০ মার্কিন ডলারে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় কেজি ৫৫ টাকা ৬০ পয়সা। আমদানিকারকের আমদানির মূল্যের ওপর কাস্টমস ডিউটি ও ভ্যাট আদায় না করে কাস্টমসের বেঁধে দেওয়া ট্যারিফ মূল্যের ওপর কাস্টমস ডিউটি ও ভ্যাট আদায় করছে ৩২ টাকা ৬০ পয়সা। এতে আমাদের অতিরিক্ত ডিউটি দিতে হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য খরচতো আছেই।

তিনি আরও বলেন, আমদানি মূল্য ও কাস্টমস শুল্ক, গোডাউন ভাড়া, লেবার খরচ ছাড়াও পরিবহনসহ দুই দেশের অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তাদের আরও অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। সব মিলিয়ে ঢাকার পাইকারের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত আমদানি করা ভারতীয় কাঁচা মরিচের দাম পড়ে যায় ২০০ থেকে ২২০ টাকার মতো। এর সঙ্গে বাজারের টোল ও সামান্য লাভ যোগ করে পণ্য বিক্রি করেন তারা।

এদিকে, বর্তমানে দেশী কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। তবে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা।

কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধিতে ক্রেতারা দুষছেন খুচরা বিক্রেতাদের, খুচরা বিক্রেতারা বলছেন পাইকারি বাজারে দাম বেশি। অন্যদিকে, পাইকারি ব্যবসায়ীরা দোষ চাপাচ্ছেন আমদানিকারকদের ওপরে।

সরেজমিনে রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।

এদিকে, কাঁচা মরিচে দাম না কমায় বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে আকাশছোঁয়া কাঁচা মরিচও ভোক্তাদের পকেট কাটছে।

রাজধানীর মালিবাগ বাজারে কাঁচা মরিচ কিনতে আসা আফরোজা আক্তার বলেন, ‘আগে আমরা ১০-২০ টাকার কাঁচা মরিচ কিনতাম। এই কাঁচা মরিচই তিন-চার দিন যেত। গত এক সপ্তাহ ধরে ২০ টাকার কাঁচা মরিচ কিনতে পাওয়া যায় না। ৫০ টাকার নিচে কোনো দোকানদার কাঁচা মরিচ বিক্রি করতে চাচ্ছে না।’

কাওরান বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে আসা মামুনুর রশিদ নামের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যে যেভাবে পারছে ভোক্তার পকেট কাটছে। চাল, ডাল, তেল, লবন, চিনি কোন জিনিসটার দাম বাড়েনি। এখন আবার কাঁচা মরিচ। কয়েকদিন পর পর একেক জিনিসের দাম হুট করেই বেড়ে যায়। আলুর দামও বাড়তে শুরু করেছে।’

এদিকে, বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকারি সংস্থাগুলো। এর মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছে। রাজধানীসহ সারাদেশে কাঁচা মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সংস্থাটি। তবে আশানুরুপ দাম নিয়ন্ত্রণ এখনও হয়নি।

ভোক্তা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কাঁচা মরিচের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ জানতে গত ০৫ জুলাই রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত দুটি টিম রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ি বাজারে অভিযান চালায়। এ সময় কারওয়ান বাজারে এক ঘন্টার ব্যবধানে কেজি প্রতি পাইকারি মূল্য ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা রাখা, মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, ক্রয় বিক্রয়ের ক্যাশ মেমো ঠিকমত প্রদান না করায় দুটি প্রতিষ্ঠানকে তাৎক্ষণিক এক লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া নিয়মিত সারাদেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘কাঁচা মরিচের মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিক কিছু কারণ আছে যেমন, বৃষ্টি, ঈদের সময়ে পরিবহন সমস্যা, ছুটির জন্য পোর্ট বন্ধ থাকা ইত্যাদি। কিন্তু কাঁচা মরিচের মূল্য যে পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য কাঁচা মরিচের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে।’

তিনি আরও বলেন, যে সকল ব্যবসায়ী নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করবে, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধির যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। মূল কারণ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা। কয়েকদিন আগে এক আমদানিকারকের সঙ্গে কথা হলো- তিনি বললেন, ‍তার কেনা হচ্ছে ২০ টাকা, সরকারি রাজস্ব দিতে হয় ৩৯ টাকা এবং অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তিনি বিক্রি করছেন ১৫০ টাকা। তার মানে ক্রয় মূল্য, খরচ, সরকারি রাজস্ব দেবার পরও তার লাভ ডাবল। একজন আমদানিকারক অর্ধেকের বেশি লাভ করছেন। কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধির মূল কারণই হচ্ছে অতি মুনাফা।’

তিনি আরও বলেন, ‘যখন আমদানি শুরু হলো তখন দুই/এক দিন দাম কমেছিল। পরে আবার দাম বৃদ্ধি হওয়া শুরু হলো। ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারলো যে তারা যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে দাম বাড়ায় তাহলে তাদের বলার কেউ নেই। ভোক্তা অধিদপ্তর কিছু জায়গায় অভিযান করছে। কিন্তু বেশির ভাগ জায়গায় ক্রয় রশিদ দেখাতে পারেনি ব্যবসায়ীরা। ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, কি দামে কিনেছে, কার থেকে কিনেছে ক্রয় এবং বিক্রয় রশিদ সঙ্গে রাখতে হবে। তারপরও তারা রাখছে না। ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযানে গিয়ে দুই/চার হাজার টাকা জরিমানা করছে। একই অপরাধ তারা বার বার করছে।’

ক্যাব সহ-সভাপতি আরও বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা একটা কারণ। আর একটা কারণ আইনের প্রয়োগ না থাকা। আইনে বলা আছে- এক ব্যক্তি একই অপরাধ বার বার করলে তার ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কোনোটাই হচ্ছে না। যারা আমদানিকারক তারা কেন দ্বিগুন মুনাফা করবে? এগুলো দেখা দরকার। কেউ না দেখলে তো তারা তাদের মতো দাম বৃদ্ধি করবেই।’

-এসআর