‘একইসঙ্গে জ্বালানি উন্নয়ন ও দক্ষতা উন্নয়নের কৌশল নিতে হবে’

স্থপতি ইকবাল হাবিব: শ্রদ্ধেয় সুধী আমার সালাম নেবেন। অনেক ধন্যবাদ ক্যাবকে। আমি প্রথমেই ক্যাবের সাবেক সংগঠক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ভাইয়ের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তার অনুপস্থিতিতেই আমার আজকে উপস্থিতি, এটা আমার জন্য একটি নতুন ঘটনা। এর আগে ক্যাবের সঙ্গে যা করেছি, তাকে পাশে পেয়েছিলাম। অথচ আজ তিনি নেই। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ক্যাবকে বলতে চাই, সবাই হাল ছাড়লেও ক্যাব হাল ছাড়ছে না। এ ধরনের প্রোগ্রাম জনগণের স্বার্থে, জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজে দেয়। বলে যাওয়াই আমাদের কাজ, এবং আমরা বলে যাচ্ছি।

একটা ছোট্ট শিশু, কিশোরী বলা যায়- গ্রেটা থুনবার্গ। গত কয়েকবছর ধরে সে আমাদের বলে আসছে, সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করুন, বাস্তবতাকে বিশ্বাস করুন। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং অর্থনৈতিক ভাবে মুনাফা লাভের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের ভবিষৎকে আপনারা ধ্বংস করবেন না। 

সেই রকম ধারণা থেকে আপনাদের একটা ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাই। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র যখন শুরু হয়, চুক্তি স্বাক্ষর করার পর মূল্য নির্ধারনের পর্যায়ে তখন একটি যৌথ আলোচনা সভায় আমরা কয়েকজন উপস্থিত ছিলাম। আমার সঙ্গে বদরুল ইমাম সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে স্পষ্ট ভাবে তাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, তখনও পর্যন্ত তারা ইআইএ তথা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের কাজটা করেনি। অথচ চুক্তি হয়ে গেছে, মূল্য নির্ধারণের কাজও চলছে।

যদিও রাষ্ট্রের তিনটি আইন স্পষ্ট ভাবে বলছে, এই কাজটি না করে কোনো ধরনের চুক্তি, কোনো ধরনের কার্যক্রম কোথাও শুরু করা যাবে না। তবুও এ কাজটি হয়েছে, রাষ্ট্রেরই তত্ত্বাবধানে, সবার নাকের ডগায় বসে। তখন বলেছিলাম, এখনো বলছি, আমাদের পরিবেশ ধ্বংস হবে এবং তার প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাবো এবং বিদেশিরা আমাদের জ্ঞান দেবে, এটা মোটেও কাম্য না। ক্যাবের মাধ্যমে আমি আজ যে আলোচনা তুলে ধরতে চাই, আজ যে উপস্থাপন করবো সেটি মূলত আমার ভবিষৎ প্রজন্মের পক্ষ থেকে।

আমাদের অবশ্যই স্থানীয় প্রযুক্তিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি কৌশল সুনির্ধারিত করতে হবে এবং এটি কেবলই লোক দেখানো কাজ হিসেবে করা যাবে না। এক্ষেত্রে আমাদের চাহিদা কতখানি, সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করা উচিৎ। আপনি একটি দোতলা ভবনের জন্য আটতলা ভবনের বেজমেন্ট তৈরি করতে পারেন না। আটতলা ভবনের ফাউন্ডেশন দিয়ে দোতলা ভবন করতে পারবেন না। 

৫০ শতাংশের অধিক ক্যাপাসিটি তৈরি করে সে ক্যাপাসিটি ফেলে রেখে তার জন্য আপনি জনগণের টাকা ধ্বংস করতে পারেন না। এগুলো করতে গিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য গত ১৫ বছর থেকে ২০ বছর কিছুই করা হয়নি, অবজ্ঞা করা ছাড়া। আমরা যদি চাহিদা পরিমাপ করি এবং তার একটা অংশও নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে পূরণ করে করে এগোতাম, তাহলে এতদিনে পরস্থিতির অনেক উন্নতি হতো। অনেকগুলো নীতিগত বিষয়ে সরকারও আমাদের সঙ্গে একমত, কিন্তু আমরা দেখি, সে অনুযায়ী তারা কাজ করে না। আইনে যা বলা হয়েছে, তাদেরই করা আইন, সেটা আবার তারাই মানে না।

সরকার অনেক ক্ষেত্রেই ভর্তুকি দেয়, ভারসাম্য রাখার জন্য। কিন্তু সেই ভর্তুকির অর্থে সত্যিকার অর্থে স্থানীয় প্রযুক্তিতে যে উন্নয়ন সহজ, যে উন্নয়ন সম্ভব তাকে প্রণোদিত করার কার্যক্রম দেখি না। নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে যেভাবে জোরালো করার দরকার ছিলো, যাতে আমাদের প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষেরা এ প্রযুক্তি দিয়ে তাদের প্রয়োজন মিটাতে পারে, সেভাবে কাজটা করা হয়নি। শুধু বিপুল চাহিদার গল্পগুলো বলে বাড়তি ক্যাপাসিটি তৈরি করে এবং তাদেরকে প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে সংকটের মধ্যে ফেলে রেখেছে। সরকারের পরিকল্পনা ও নীতি যদি সঠিক না হয়, তাহলে এ ভুর্তকি নিয়ে জনগণ করবেটা কি? এটা কাজে লাগবে না। এ জায়গায় আমাদের কার্যকর জ্বালানি উন্নয়ন কৌশল নিতে হবে।

আলাদা ভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিভাগ তৈরি হোক। যারা এ ব্যাপারে প্রণোদিত করবে। আমাদের চাহিদার সঙ্গে জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সমন্বয় করে এ বিষয়ক কৌশলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের একইসঙ্গে জ্বালানি উন্নয়ন ও দক্ষতা উন্নয়নের কৌশল নিতে হবে। পাশাপাশি এই কৌশলগুলোকে আমাদের পরিবেশ সুরক্ষায় সক্ষম হতে হবে। মহামারির মতো নেমে এসেছে পরিবেশের ওপর। 

নানা ভাবে আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। আমাদের খাল, বন বলে কিছু নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে আমরা দাঁড়াবো কি বলে, সে ভাষা আমার জানা নেই। তাই এ বিষয়ে আর্থিক প্রণোদনাসহ নানাবিধ কৌশলে আমাদের সক্রিয় হতে হবে। শুধুমাত্র এখানে উৎপাদন, পণ্য, বিনিয়োগ, পুঁজি, লাভ, এগুলোই সব নয়। আপনি ভবিষ্যতে টাকা খেতে পারবেন না, টাকা দিয়ে আপনি ভবিষ্যতের এ উত্তাপ কমাতে পারবেন না। উত্তপ্ত হচ্ছে পৃথিবী, শুধু বাংলাদেশ না। আপনারা জানেন কি না, গত চার সপ্তাহের যে ঘটনা, যখন দুবাইয়ে তাপমাত্রা ছিলো ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর তখন আমাদের দেশে ছিলো ৪১ ডিগ্রি। বুঝতে পারছেন, কি অবস্থা হচ্ছে?

জ্বালানি খাতে দক্ষ, কারিগরি দিক থেকে প্রশিক্ষিত লোকবল নিয়মিত তৈরি করার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি আকাশ ভাইয়ের সঙ্গে একমত। বদরুল ইমাম ভাইদের মতো লোকেরা কেন দেশ ছেড়ে চলে গেছে? ভারতসহ অনেক দেশ দেখিয়েছে, কিভাবে তাদের ফেরত আনা যায়। তারা ফেরত এলেই দেশ শক্তিশালী হবে। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, স্বনির্ভর বাংলাদেশ তৈরি করতে। এখন আমরা স্বনির্ভর শব্দটা ভুলে গিয়েছি। যেকোনো কিছুর জন্য আমরা বিদেশিদের দ্বারস্থ হচ্ছি। পরিবেশ ও জলবায়ু সংরক্ষণে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি ও সিদ্ধান্ত রয়েছে, তাকে যারা পদদলিত করে, বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণে তাদের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটা যারা উপেক্ষা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ, প্রতিউচ্চারণ জারি রাখতে হবে। 

কারণ ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্য পরিবেশ অধিকার ও জলবায়ু সংরক্ষণ উন্নয়ন ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা বাধ্য। এটা আমাদের অঙ্গিকার, এটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং সাংবিধানিকভাবে এটা আমাদের দায়ও বটে। এ দায় প্রতিপালন করতে হবে।

আমরা আমাদের নির্গত বর্জ্যরে নিরাপদ ব্যবস্থাপনা, কার্বন নির্গমন প্রশমনে এখনো সঠিক নীতিমালার ব্যবস্থা করতে পারিনি। শুধু উৎপাদন নয়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সকল ধরনের উৎপাদনের ক্ষেত্রে তার পরবর্তী ঘটনাবলি কি সেটা এখনই আমাদের সুনিশ্চিতভাবে ভবিষৎ প্রজন্মকে জানাতে হবে। এই যে কাজটুকু করছি না, এর জন্য বদরুল ইমাম ভাইয়ের মতো করে বলতে হয়, অনেক বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে। আমাদের এখনই শুরু করতে হবে। জলবায়ু তহবিল থেকে সহযোগিতা পাওয়ার একটা মুলা ঝুলানো হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে আমরা কোনো ঋণ গ্রহণ করতে চাই না। 

স্পষ্টভাবে বলছি, আমরা চাই আমাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ। ঋণের মাধ্যমে যেন ঢোল না পেটাই যে, আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। এটা সহযোগিতা তহবিল এবং আমরা ক্ষতিগ্রস্ত তাই আমাদের প্রাপ্য এখান থেকে আদায় করতে হবে। এ তহবিল দিয়ে আমরা যেন আমাদের সক্ষমতা উন্নয়ন করতে পারি এবং বিকল্প জ্বালানি তৈরি করার জন্য এটা যেন কাজে লাগে, গবেষণা তৈরির কাজে লাগে, লোকবল তৈরির কাজে লাগে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির সৌর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বলা হয়, আমাদের সূর্যের আলোর উপযোগিতা কম। কম বলেই যে উৎপাদন করবো না, এ ধরনের আহাম্মকি করার মানে হয় না। আমাদের যা রয়েছে, তা দিয়েই ভালো পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। আমাদের চেয়েও যাদের সৌরবিদ্যুতের উপযোগিতা কম, তারা বসে নেই, সীমিত সম্ভাবনাকেই তারা কাজে লাগাচ্ছে, কারণ এটাই আগামীর পথ। আমরাও বসে থাকতে পারি না। কিভাবে ব্যয় কমানো যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সব ধরনের চেষ্টা করবো।

আপনারা জেনেছেন, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমার চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পেছনে যে বিনিয়োগ করতে হয়েছে তার জন্য এখন আমাদের এক টাকার জিনিস ৮৩ টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। জ্বালানি খাতে সঠিক পদক্ষেপ নিলে এখন আমাদের গ্যাসের জন্য বিদেশে ছুটতে হতো না। কিন্তু তা না করে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে আর আমরা সেই বিদ্যুৎও পাচ্ছি না। 

একদিকে কম ব্যয়ে উৎপাদনে সক্ষম গ্যাসপ্লান্টগুলো বসিয়ে রাখছি অন্যদিকে যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র অপ্রয়োজনে করা হয়েছে, তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছি। এসব করতে গিয়ে আমরা জনগণের অর্থের বিনাশ করছি এবং আমাদের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রবণতা তৈরি করেছি। 

আমি মনে করি, ইকুইটি, সাসটেইনেবিলিটি আমাদের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ। এটিকে কার্যকর করতে হবে ভবিষৎ প্রজন্মের স্বার্থে। এ বিকল্প জায়গাগুলো এবং পরিবেশ আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সব কিছু দেখার চেষ্টা করতে হবে। কী হচ্ছে, কি হতে যাচ্ছে আপনারা সেটা জানেন। ভবিষ্যৎ চুক্তিগুলো, চুক্তিগুলোর বিষয়বস্তু তো আপনারা জানবেন। এভাবে চলতে থাকলে দেখবেন যে, চুক্তিগুলো আমাদের কত বড় বিপর্যের মধ্যে ফেলে দেবে। শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ থেকে প্রথাগতভাবে কাগজে কলমে ভালো কথা বললে এমন সব কাজ হবে, যার ক্ষতি আমরা সামাল দিতে পারবো না। 

ক্যাবের মাধ্যমে আপনারা সবাই এটা জোরালো ভাবে তুলে ধরবেন।

আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, সরকারের সদিচ্ছার বিভিন্ন ইঙ্গিত দেখি, তার বাস্তবায়ন চাই। বিভিন্ন সমমনা ছোট ছোট উদ্যোগ দেখি, কিন্তু প্রবল উদ্যোগ চাই। রাষ্ট্রের যে কমিটমেন্ট তা যেন কার্যকর ভাবে আমাদের সামনে প্রকাশ পায়, সেটা দেখতে চাই।

স্থপতি ইকবাল হাবিব: নগর পরিকল্পনাবিদ এবং এবং সদস্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশন, ক্যাব।

[২৯ এপ্রিল ২০২৩ শনিবার, রাজধানীর তোপখানা সড়কে অবস্থিত সিরডাপের এ টি এম শামসুল হক অডিটোরিয়ামে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর উদ্যোগে ‘ক্যাব-এর সংস্কার প্রস্তাব প্রেক্ষিত: ‘জ্বালানি সংকট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন’ শীর্ষক বিষয়ে এক নাগরিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ‘স্থানীয় প্রযুক্তিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কৌশল, জ্বালানি সংরক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কৌশল এবং পরিবেশ ও জলবায়ু সংরক্ষণ উন্নয়ন’ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব যে আলোচনা করেন তার শ্রুতিলিখনের ওপর ভিত্তি করে লেখাটি প্রস্তুত করা হয়েছে।]