নিত্যপণ্যের বাজার : স্বস্তি কোথায়?

এস এম নাজের হোসাইন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

দেশে বহুদিন ধরেই লাফিয়ে লাফিয়ে দফায় দফায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে অনেক পণ্যের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে বেড়েছে ডাল ও ডিমের দাম। ওদিকে আমনের ধান কাটা প্রায় শেষ হয়ে এলেও চালের বাজারে মিলছে না সুখবর।

সরকারি হিসাবেই মোটা চালের কেজি এখন ৪৮ টাকা হয়েছে। বাজারে যা কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৫০ টাকা পর্যন্ত। ফলে প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষরা একটু ডাল-ভাত কিনে খাবে সে উপায়ও নেই। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষজনের নাভিশ্বাস উঠে গেছে।

সাধারণ ভোক্তাদের অভিযোগ, সরকার নিত্যপণ্যের বাজারের মূল দায়িত্ব ব্যবসায়ীদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে, ফলে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষও সাধারণ মানুষের এই আকাঙ্ক্ষিত নিত্যপণ্যের বাজার তদারকির ন্যূনতম দায়িত্ব পালনে কোনো আগ্রহ নেই। যার কারণে বাজারে এক লাফে জিনিসের দাম দ্বিগুণ হারে বেড়েই চলেছে।

বাজারে অনেক ক্রেতাদের অভিযোগ, বিগত সপ্তাহের থেকে চলতি সপ্তাহে অনেক নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ। পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, চিনি, ময়দা, মসুর ডালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। যেসব ব্যবসায়ীদের মজুদ ছিল তারাই লাভবান হয়েছে। আর যাদের মজুদ ছিল না তাদের বেশি দামে কিনে, বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

ভোক্তা ও নিত্যপণ্যের বাজার বিশ্লেষকদের মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার বাড়তি খরচের চাপ থেকে মানুষ বের হতে পারছে না। বাজার ক্রমাগত অসহনীয় হয়ে উঠছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি, ডিম, মাছ, মাংসের মতো পণ্যের দাম আগে থেকেই চড়া। এরপর ভরা মৌসুমেও শাকসবজির দাম সীমিত ও শ্রমজীবী মানুষের নাগালের বাইরে।

সামগ্রিকভাবে বাড়তি জীবন জীবিকার খরচের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রান্তিক, শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই এখন চাহিদার তুলনায় কম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এতে পুষ্টি সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
শুধু কাঁচাবাজারই নয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, টয়লেট্রিজ ও গৃহস্থালি পণ্য, ওষুধপত্র, নির্মাণসামগ্রী, রান্নার গ্যাসসহ প্রায় সব জিনিসের দাম ক্রমাগতভাবেই বেড়েই চলেছে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে মানুষের গণপরিবহনে যাতায়াত খরচও বেড়েছে আগের তুলনায়। সামগ্রিকভাবে বাড়তি জীবন জীবিকার খরচের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রান্তিক, শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই এখন চাহিদার তুলনায় কম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এতে পুষ্টি সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মজুরির হার বেড়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, যা গত ১৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতি এখন প্রতি মাসেই বাড়ছে। ফলে প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষের বাড়তি আয় খেয়ে ফেলছে জিনিসপত্রের দাম। করোনার কারণে কাজ হারিয়ে যারা ঋণগ্রস্ত, তাদের অনেকেই বাড়তি আয় করেও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।

পুরো বছর জুড়েই দফায় দফায় একেকবার একেকটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় রয়েছে আগের অবস্থায়। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষ। প্রতিদিনকার চাহিদা মেটাতে তাদের গুনতে হচ্ছে পণ্যের অস্বাভাবিক দাম।

দেশের ও সাধারণ মানুষের বর্তমান অবস্থাকে পুঁজি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে সরবরাহ লাইনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে চলছে। জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ২/১জন কর্মকর্তারা নিয়মিত বাজার তদারকি করেও এই নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে পারছেন না। যার ফলে দুই থেকে তিনগুণ দাম বেশি দিয়েই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা আছে। কারণ করোনা মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক ধরনের শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল, জ্বালানি তেলের দাম ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং মধ্যবর্তী পণ্যের দাম বেড়েছে। করোনার ধাক্কা সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলে সারাবিশ্বেই ভোগ্যপণ্য ও শিল্পপণ্যের অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়েছে। হঠাৎ করে সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ফলে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে।

কোনো সবজিই এখন স্বাভাবিক দামে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ পৌষ, মাঘ মাসে শীতকালীন সবজির দাম কম থাকে। কয়েকবার বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। এখন আবার দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের নির্ধারিত দামেও সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।
এছাড়া আরেকটি কারণ হলো, জাহাজসহ অন্যান্য পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি। জাহাজ ভাড়া যেমন বেড়েছে, তেমনি পণ্য সরবরাহে বেশি সময়ও লেগেছে। তবে এসব কারণে যতটুকু বাড়ানো উচিত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারচেয়ে বেশি দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। আর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন কিছু ব্যবসায়ীরা।

আবার কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। যেমন, পেঁয়াজ সংকটের সময় দেশীয় পেঁয়াজেরও দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই গিয়েছিল। ঠিক একইভাবে ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে। কোনো সবজিই এখন স্বাভাবিক দামে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ পৌষ, মাঘ মাসে শীতকালীন সবজির দাম কম থাকে। অন্যদিকে এসময় খাল-বিল, ঘের শুকিয়ে আসায় মাছের সরবরাহ বেড়ে দামও কমে যায়। এ বছর সরবরাহ বাড়লেও দাম কমছে না। কয়েকবার বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। এখন আবার দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের নির্ধারিত দামেও সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।

চাহিদার তুলনায় কম হলেও দেশে প্রায় সব নিত্যপণ্যই কমবেশি উৎপাদিত হয়। এ অবস্থায় সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সময়মতো নিত্যপণ্য আমদানি করা হলে বাজারে কোনো পণ্যের বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা থাকে না। পেঁয়াজ নিয়ে এত আলোচনার পর পেঁয়াজের উৎপাদনের ভরা মৌসুমে এখনো এ পণ্যের আমদানি উন্মুক্ত থাকা দুঃখজনক।

সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করাও সম্ভব হতে পারে। বাজারে পণ্যমূল্যে স্থিতিশীলতা রাখতে অসাধু ব্যবসায়ীদের শক্তির উৎস খুঁজে বের করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপণ্যের বাজারের দায়িত্ব পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা মুক্তবাজার অর্থনীতির ধুয়া তুলে দাম বাড়ালেও দাম কমলে বলছে, বেশি দামে কেনাসহ নানা অজুহাত। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপণ্যের বাজারের দায়িত্ব পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা মুক্তবাজার অর্থনীতির ধুয়া তুলে দাম বাড়ালেও দাম কমলে বলছে, বেশি দামে কেনাসহ নানা অজুহাত।
আবার নিত্যপণ্যে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথাবার্তা উঠলেই ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দোষারোপ করে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপাতে চান। মাঝে মাঝে বলে থাকেন, সরকার কেন বাজার তদারকি করছে না। তবে বাজারে তদারকি টিম পাঠাতে বললেও তাদের ব্যবসায় নয়, অন্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর পরামর্শ দেন। তাদের প্রতিষ্ঠানে পাঠালে পরিস্থিতি অস্থির হতে পারে; এরকম প্রছন্ন হুমকি প্রদান করে বাজার তদারিকতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। সেকারণে ঢাকা শহরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি টিম বাজার তদারকি করার কথা থাকলেও বাজারে ভোক্তারা এই টিমের দেখা পান না।

জেলা শহরে জেলা প্রশাসনের বাজার তদারকি টিম মাঠে থাকার কথা থাকলেও অনেকেই ফটো সেশনের মতো বাজার তদারকি করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিলেও এই তদারকি কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। তবে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা দিয়ে খুচরা বাজারে কিছু অভিযান পরিচালিত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জেলা বাজার কর্মকর্তা শুধুমাত্র পাইকারি দোকানের বাজার দর সংগ্রহ করেন, যার সাথে ভোক্তার সংশ্লিষ্টতা কম। যে কারণে ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অনুযায়ী দোকানে মূল্য তালিকা টাঙানোর নির্দেশনা আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।

এ অবস্থায় দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক জনগোষ্ঠী ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রথমত, আমদানি, পাইকারি ও খুচরা উভয় পর্যায়ে বাজার তদারকি বাড়ানো; দ্বিতীয়ত, বিকল্প ব্যবস্থাপনায় চাল, আটা, চিনি, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্য প্রান্তিক, শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি; বিশেষ করে করোনাকালে যাদের আয় কমে গেছে, তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাও বাড়াতে হবে।

গ্রাম ও শহরাঞ্চলের প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষ যাতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে, সেজন্য নিত্যপণ্যের দাম যেমন স্থিতিশীল রাখতে হবে। তেমনি তাদের আয় বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে। এসব পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি কতটা নিয়ন্ত্রণে আসে, সেদিকে তাকিয়ে আছে মানুষ। না হলে বাজার তদারকি শব্দটি জাদুঘরের শব্দ ভাণ্ডারে স্থান পাবে।

খবর: ঢাকা পোস্ট