‘জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে বিনিয়োগ চুক্তিগুলো করতে হবে’

অধ্যাপক এম এম আকাশ: ধন্যবাদ ক্যাবকে। তবে বিশেষভাবে অভাব অনুভব করছি, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ভাইয়ের। তার উপস্থিতিতে এ ধরনের অনুষ্ঠানে বহুবার বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছিলো। তার স্মৃতির প্রতি পূনরায় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। এবং ক্যাব যে নাগরিকদের পক্ষ থেকে তাদের যে প্রস্তাবনায় অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিয়েছে সেজন্য ক্যাবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এ প্রস্তাবনার যে অংশে স্ট্র্যাটেজিক ও সামষ্টিক দিক আলোচনা করা হয়েছে সেগুলোকে আমি বিস্তারিত যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিয়ে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করবো। প্রস্তাবনার ভেতরে যে লেখা আছে সেটার আর পুনরাবৃত্তি করবো না। তবে এর পরিপূরক যে ব্যাখ্যা করার কথা সেটা আপনারে সামনে উপস্থাপন করবো। আমার দিক থেকে আমি যেটা বুঝেছি, এখানে ছয়টি দিক খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব দিক আমি ব্যাখ্যাসহ আলাদাভাবে উপস্থাপন করছি।

প্রথমত, মালিকানা। যেহেতু জ্বালানি একটা প্রাকৃতিক সম্পদ এবং আমাদের সংবিধান অনুযায়ী প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হলো জনগণ, দেশের মানুষ। এটা জাতীয় মালিকানায় থাকতে হবে। জাতির প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রের মালিকানায় থাকবে। সুতরাং এখানকার সমস্ত গ্যাস, কয়লা, সম্পদ সেটা সমুদ্রগর্ভেই থাকুক নয়তো মাটির তলায়ই থাকুক সেটার মালিক হতে হবে জনগণ এবং জনগণের পক্ষ থেকে জনগণের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। এগুলো যখন আমরা উত্তোলন করে কাজে লাগাতে যাবো, তখন সেটার জন্য প্রতিষ্ঠান লাগবে, এন্টারপ্রাইজ লাগবে, ইনভেস্টমেন্ট লাগবে। তখন প্রশ্ন আসবে সেইসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানার ধরন তথা রাষ্ট্র বা সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন হবে এবং তাদের কার্যক্রমের উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে কিনা, সর্ম্পূণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে কিনা, আংশিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে কিনা, যৌথ সহযোগিতা থাকবে কিনা, ইত্যাদি।

আমাদের সংবিধান বলে তিন রকমের মালিকানা আমরা সমর্থন করি। আমরা মিশ্র অর্থনীতির দেশ। আমরা সমর্থন করি রাষ্ট্রীয় মালিকানা, আমরা সমর্থন করি যৌথ বা সমবায় মালিকানা, আমরা সমর্থন করি ব্যক্তিগত মালিকানা। বলা হয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠান ও সম্পদের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে এবং যেগুলো বৃহৎ প্রতিষ্ঠান, এটা নিও ক্লাসিকাল অর্থনীতিতেও স্বীকার করে নেওয়া হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানের এক্সটার্নাল ইকোনমিক গুরুত্ব রয়েছে, অর্থাৎ আপনি যে কাজ করছেন ওই কাজের ফলাফল লোকসান বা খরচের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। ওটার লাভ লোকসান ঢেউয়ের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যেমন ইটের ভাটার ক্ষতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন গ্যাস, বিদ্যুতের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেলে সারাদেশে একটা মুদ্রাস্ফীতি হয়ে যাবে, সারা অর্থনীতি লন্ডভন্ড হয়ে যাবে, সেগুলো বাজার বা ব্যক্তিমালিকানার ওপর নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছেড়ে ওেয়া যাবে না।

আরেকটা বিষয় অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, যেসব মালিকানা অল্প কিছু লোকের হাতে সীমাবদ্ধ থাকলে তাদের একটা মনোপলি ক্ষমতা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না বাজারের সঙ্গে বা অন্যখাতের সাথে সেগুলোরও ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত মালিকানা থাকা উচিত নয়। আর বিশেষ করে কতগুলো জিনিস রয়েছে, যেগুলো ন্যাচারাল মনোপলি, মানে আপনি যত বড় পরিসরে উৎপাদন করলেন ঠিক তত উৎপাদন খরচ কম হবে। আর যে এরকম পণ্য বেশি উৎপাদন করবে তিনি রাঘব বোয়ালের মতো একমাত্র রাজায় পরিণত হবে। কারণ খরচের দিক দিয়ে ছোটরা তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারবে না। এ ধরনের খাতগুলো মিশ্রমালিকানার অর্থনীতিতে বলা হয় কমান্ডিং হাইটস, এসব খাতকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রাখতে হবে।

আমি ক্যাবের প্রস্তাবের এই দিকটায় আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ক্যাব প্রস্তাবে বলছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রধান হতে হবে। আর ব্যক্তি মালিকানা যদি থাকে, তাহলে সেটাকে রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে আলাদা রাখতে হবে এবং তার সঙ্গে লেভেল গ্রাউন্ডে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। লেভেল গ্রাউন্ড না থেকে এখন যেটা হচ্ছে, বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে, সরকার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে ব্যক্তি মালিকদের দ্বারা। লেভেল গ্রাউন্ডে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা না করে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণ করছে। সরকারের যে রাষ্ট্রীয় গ্যাস, তেলের প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলোকে আস্তে আস্তে ডিজবান্ডেল করছে। এবং আস্তে আস্তে সেগুলোর মালিকানা ছেড়ে দিচ্ছে। এরপর যখন ওইসব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে দাম বাড়াচ্ছে তখন স্ট্র্যাটেজিক পণ্য হিসেবে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকার আর রাখছে না। যতগুলো প্রতিষ্ঠান সরকার তৈরি করেছিলো, সেগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণ করেছে। আর এগুলোর বিরুদ্ধে যাতে কেউ আন্দোলন সংগ্রাম না করতে পারে, সেজন্য ইনডেমনিটি আইন তৈরি করে রেখেছে। এখানে যার মালিক হবার কথা ছিলো সে মালিক হতে চাচ্ছে না। আর যার মালিক হওয়ার কথা নয়, তাকে মালিক বানানোর জন্য সব রকম সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দিচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ। একটা যুক্তি দেখানো হয়, তা হলো ক্ষমতা, প্রযুক্তির অভাব, বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব। ক্যাবের দ্বিতীয় প্রস্তাবটা এই বিনিয়োগের বিষয়ে। যদি আপনি জয়েন্ট মালিকানা করতে চান, তাহলে আগে দেখতে হবে, আমাদের জাতীয় ক্যাপাসিটি আছে কি নাই এবং তারপর দেখতে হবে বিদেশি ক্যাপাসিটি। আমরা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখি, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাসের অভিজ্ঞতার থেকে যদি দেখি, দেশীয় সক্ষমতাকে যদি সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। বিদেশি বিনিয়োগের যদি প্রয়োজন হয়ও তবে সেটা ভাড়া করে আনা যায়। বহু আগে সমুদ্র গর্ভে গ্যাস উত্তোলনের বিষয়ে সামিটের আব্দুল আজিজ খানের সঙ্গে আমার টিভিতে একটা আলোচনা হয়েছিলো। সেখানে সামিটের আব্দুল আজিজ খান বলেছিলেন, সরকার যদি আমাদের সুযোগ দেয়, তাহলে বিদেশিদের দিয়ে সমুদ্রগর্ভে গ্যাস উত্তোলনের দরকার নেই। প্রযুক্তি আমরা ভাড়া করে আনতে পারি, তবে আমাদের পুঁজির অভাব আছে। কনসোর্টিয়াম করে যদি আমাদের পুঁজি দেয় তাহলে এটা সম্ভব।

[২৯ এপ্রিল ২০২৩ শনিবার, রাজধানীর তোপখানা সড়কে অবস্থিত সিরডাপ-এর এটিএম শামসুল হক অডিটোরিয়ামে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ(ক্যাব)-এর উদ্যোগে‘‘ক্যাব-এর সংস্কার প্রস্তাব প্রেক্ষিত: ‘জ্বালানি সংকট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন’’শীর্ষক বিষয়ে এক নাগরিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ‘ন্যায্যতা, সমতা ও স্বচ্ছতা উন্নয়ন কৌশল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়ন কৌশল এবং বিনিয়োগ উন্নয়ন কৌশল’ বিষয়ে অধ্যাপক এম এম আকাশ যে আলোচনা করেন তার শ্রুতিলিখনের ওপর ভিত্তি করে লেখাটি প্রস্তুত করা হয়েছে।]