মানহীন খাবারের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ জরুরি

এস এম নাজের হোসাইন: সংযমের মাস রমজান চলছে। খাবারের দোকানগুলো দিনের বেলায় বন্ধ থাকলেও বিকাল থেকেই রোজার অপরিহার্য পণ্য ইফতারসামগ্রী বিক্রিতে বেশ ধুমধাম। ইফতারিতে বিক্রি হওয়া পণ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর উপাদান মিশানো হচ্ছে। এতে ইফতারির চাকচিক্যতা বাড়লেও অনিরাপদ এসব ইফতারি। ইফতারসামগ্রী আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল রং। ফুটপাতসহ বিভিন্ন খাবারের দোকানে ময়দার সঙ্গে কেমিক্যাল রং মিশিয়ে, পোড়া তেলে ভেজে তৈরি করা হচ্ছে ইফতারি। বেগুনি, পেঁয়াজু, ডালের বড়া, নিমকি, আলুর চপসহ অনেক ধরনের ইফতারসামগ্রী আকর্ষণীয় করতে ব্যবহৃত হচ্ছে কেমিক্যাল রং। জিলাপি দীর্ঘ সময় মচমচে রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে পোড়া মবিল। মুড়ি সাদা করতে ব্যবহার হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। বুন্দিয়া, জিলাপিসহ মিষ্টান্নজাতীয় খাবার তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে ভেজাল চিনি। এর রাসায়নিক নাম সোডিয়াম সাইক্লামেট। খাবারকে অধিকতর মিষ্টি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্যাকারিন, সুকরালেস ইত্যাদি। আবার বাসি ইফতারি মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে নতুন তৈরি করা ইফতারির সঙ্গে। এসব সামগ্রী দেদার বিক্রিও হচ্ছে।

অসাধু ব্যবসায়ীরা পবিত্র রমজান মাসে ইফতারিসহ খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশাচ্ছে। ক্ষতিকর পদার্থ মিশিয়ে খাদ্যকে বিষাক্ত করে তুলছে। খাদ্যে ভেজাল এমন একটি নীরব ঘাতক, যা ধীরে ধীরে সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্যের কারণে খাদ্যে ভেজাল মহামারি আকার ধারণ করেছে। প্রশাসনের নজরদারি আরো জোরদার করার মাধ্যমে এই ভেজাল থেকে আমাদের বের হতে হবে।

ইফতারি পণ্যের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানগুলো অনেকে জেনে, আবার অনেকে না জেনেই ব্যবহার করছেন। রেস্টুরেন্ট ছাড়াও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা রাস্তার মোড়ে, অলিগলিতে ইফতারির পসরা সাজিয়ে বিক্রি করছেন। ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজু, ডালের বড়া, নিমকি, বুন্দিয়া, আলুর চপ থেকে শুরু করে মুরগির সুতি কাবাব, হালিম, লাচ্ছি, দইসহ বহু রকমের ইফতারি বিক্রি হচ্ছে। এসব ইফতারির প্রায় সবগুলোতে কোন না কোন রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখতে সুন্দর দেখালেও বাস্তবে এর মধ্যে আছে ভেজাল। আর এই খাদ্যে ভেজালের কারণে ধীরে ধীরে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে।

রমজান রোজা মুখে নিয়ে এ রকমের সংবাদ পড়ে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। আর ভেবেছি, ‘হায় রে চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’। সংযমের কেউ ধার ধারে না, সংযম শুধু কেতাবেই বন্দি। রোজার মাসে মানুষগুলোকে তিলে তিলে হত্যার জন্য যারা ইফতারিতে বিষ মেশায়, তাদের বিচার করার কি কেউ নেই? বেঁচে থাকার জন্য মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলেইরই খাবার প্রয়োজন। সাধ্যমত আমরা সকলেই প্রতিদিন কিছু না কিছু খাই। কিন্তু এ খাবারগুলো কতুটুকু নিরাপদ?। বিশেষ করে বাহারি বিজ্ঞাপন দিয়ে চমৎকার মোড়কে সে সকল খাদ্য ও পানীয় আমাদের খেতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে তা আসলে কতখানি নিরাপদ? কোন একটি বিজ্ঞাপন বলছে ‘ইফতারিতে ভাজাপোড়া বাদ দিয়ে জুস খেতে’ আবার অন্য একটি কোম্পানি বলছে কেবলমাত্র তাদের জুস ছাড়া বাকি সবগুলোকেই প্রিজারভেটিভ দেয়া। এই প্রিজারভেটিভ শব্দটি ব্যবসায়ীদের আদুরে দল নাম। এর আসল নাম ক্ষতিকর কেমিক্যাল বা বিষ। বিজ্ঞাপনের ভাষায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে আমরা প্রতিদিন খাচ্ছি ভেজাল, খাচ্ছি বিষ!

নিারপদ খাবার খুঁজে পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। বস্ত্রকলের কাপড়ের রং দিয়ে তৈরি খাদ্যে বাজার সয়লাব। সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন কেমিক্যাল ‘ফুড গ্রেড’ খাদ্যে মেশানো হয়। কিন্তু দেশে ফুড গ্রেডের নামে প্রতারণা করা হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ খাদ্য সামগ্রীতে ফুড গ্রেড ব্যবহার না করে কাপড়ের রং মেশানো হচ্ছে। যা আমরা খাবারের নামে খাচ্ছি বিষাক্ত কেমিক্যাল। আর এই ভেজাল খাদ্যই কিডনি ও ক্যান্সারসহ নানা মরণব্যাধির জন্য দায়ী। র‌্যাব, বিএসটিআই ও ভোক্তা অধিকার বিভিন্ন সময় খাদ্যে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযান পরিচালনাকালে তারা নানা শাস্তি দিয়েও যাচ্ছেন। অভিযুক্তরা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে স্বীকার করেছেন, ফুড গ্রেডের মূল্য অনেক বেশি। অথচ এক কৌটা কাপড়ের রংয়ের মূল্য অনেক কম। অনেক দিন ব্যবহারও করা যায় এই রং। এই কারণে তারা ফুড গ্রেডের পরিবর্তে খাদ্যে কাপড়ের রং ব্যবহার করেন। সম্প্রতি রাজশাহীতে কাঁচা আমের কালারে মিষ্টি তৈরি করার সময় মোবাইল কোর্ট অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয়। এক্ষেত্রে ফুড গ্রেড ব্যবহার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

মানুষের খাবারে বিষ-পরিস্থিতি আসলে কতটুকু ভয়াবহ? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে খাদ্য দূষণ এবং খাদ্যে ভেজাল মেশানো এমন এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ এবং দূষিত খাবার খেয়ে মানুষ ডায়রিয়া থেকে শুরু করে মরণব্যাধি কান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে’। শাকসব্জি, মাছ, দুধ, ফলমূল, মিষ্টান্নদ্রব্য, আইসক্রিম, মসলা থেকে শুরু করে প্রায় সকল ধরনের খাবারে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য এবং ক্ষতিকর রং ব্যবহার করে মানুষের কাছে খাবারগুলো আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা খেয়ে মানুষ ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। বাড়ছে ডায়াবেটিস, হাপানি, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, লিভার সিরোসিসসহ নানা ধরনের রোগ। এছাড়াও বাড়ছে বন্ধ্যাত্ব এবং বিকলাঙ্গ শিশুর জন্গ্রমহণ। দেশে হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেখানে রোগীর চাপ দেখলেই বোঝা যায় সমগ্র সমাজে অসুস্থতা ক্রমশ বাড়ছে। বিভিন্ন সূত্র মতে, দেশের প্রায় ১০ ভাগ মানুষ প্রতিবন্ধী, ৬ ভাগ দম্পতি বন্ধ্যা। ইতোমধ্যেই দেশ থেকে ৫৪ প্রজাতির মাছ ও ২০৩ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়েছে। মানুষের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে মানসিক অস্থিরতা। মানুষ খুব সামান্য কারণেই রেগে যাচ্ছে এবং হিংস্র আচরণ করছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভেজাল ও রাসানিক দ্রব্যে দূষিত তথা বিষাক্ত খাবার গ্রহণ এর অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশ খাদ্য পরীক্ষাগারে তথ্যে জানা যায়, ১০০টি খাদ্যের মধ্যে মাত্র দুই একটিতে ফুড গ্রেড ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাকিগুলোতে ফুড গ্রেড ব্যবহারের প্রমাণ মেলেনি। এটা অনেকটা বিপদজনক তথ্য। এছাড়া খাদ্য পরীক্ষাগার বাংলাদেশে বাজারজাতকৃত খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে পরীক্ষাগারে ১০৭ ধরনের খাদ্য পরীক্ষা করে আসছে। যার ৯৮ ভাগই ভেজাল ও বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে সারাদেশে ৪৩টি খাদ্যদ্রব্য মোট ৫৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর এই ৪৩টি পণ্যেই ভেজাল পাওয়া গেছে। বর্তমানে বাজারে খাদ্য সামগ্রীর মানের অবস্থা একই। দেশে প্রতিবছর যত শিশু মারা যায় তার ১০ শতাংশের কারণ ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য। কাপড়ে ব্যবহƒত রঙ, কৃত্রিম ফ্লেভার, ঘনচিনি ও স্যাকারিনের দ্রবণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরনের জুস ও জেলিসহ ভেজাল খাদ্যপণ্য। আর এসব পণ্যের প্রধান ভোক্তা হচ্ছে শিশুরা। এজন্যই বাংলাদেশের দেড় থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে।

টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনে বলা হয়ে থাকে, ‘….. লজ্জা! হেইডার মধ্যেও প্রিজারভেটিভ দেয়া আছে’! সত্যিই তাই। আমাদের লজ্জাটাতেও যেন প্রিজারভেটিভ দেয়া হয়েছে আর তাই আমাদের কোন কিছুতেই আর লজ্জা লাগে না। একবার এক দোকানে মোবাইল কোর্ট গিয়ে জরিমানা করে আসার পর মুহূর্তেই সেই দোকানি আবার দ্বিগুণ উৎসাহে ভেজাল ও দূষিত পণ্য বিক্রি শুরু করে। কোন লাজ-লজ্জার বালাই নাই! এরশাদের শাসনামলকে পটুয়া কামরু হাসান কটাক্ষ করে চিত্রায়িত করেছিলেন এবং লিখেছিলেন ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’। হায় পটুয়া, আপনি যদি বেঁচে থাকতেন জানি না আজ দেশের এই পরিস্থিতি দেখে আপনি কি বলতেন! আজ দেশের যে অবস্থা তা বিশ্ব বেহায়াদেরকেও যেন লজ্জিত করে।

বাংলাদেশে আইনের শাসন বিদ্যমান বলে শাসকদল সব সময় দাবি করে থাকেন। আইনের চোখে সকলেই সমান এবং আইনের ঊর্ধ্ব কেউ নন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু দেশের সংবাদপত্র টানা সাতদিন পড়লে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন না যে এদেশে আসলে আইনের শাসন বলে কিছু আছে? অপরাধ সবদেশেই কম বেশি সংঘটিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মত এত অপরাধ বিশ্বের আর কোথায় হয় তা আমার জানা নেই। আমাদের দেশে আইনের অভাব আছে বলে মনে হয় না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ থেকে শুরু করে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা- সব বিষয়ে প্রচুর আইন আছে। কিন্তু আমরা কি দেখছি? সন্ত্রাস, খুন, সড়ক দুর্ঘটনা, খাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি এখন প্রতিদিনের সংবাদের মূল অংশজুড়ে আছে। কিন্তু এই সংবাদগুলো যেন এখন আমাদের মনে কোন অনুভূতি করে সৃষ্টি করে না! তারপর যখন আমরা দেখি পুলিশ নিজে উদ্যোগ নিয়ে কাউকে গণপিটুনিতে হত্যার বন্দোবস্ত করে, যখন আইনের লোকেরা নিরীহ লোকের পায়ের ওপর কোপ দিয়ে চাপাতির ধার পরীক্ষা করতে সচেষ্ট হয়, যখন কেবল বিরোধীদলকে শায়েস্তা করবার জন্যে আইনের ষোলকলা বিছানো হয় কিন্তু সরকারি দলের সিকিও স্পর্শ করা হয় না তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আইন সর্বজায়গায় সমভাবে প্রয়োগ হয় না।

দেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করার জন্যে বহু ধরনের আইন বিদ্যামান। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড, ক্ষেত্র বিশেষে যাবজ্জীবন অথবা ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ ধারায় কাউকে শাস্তি প্রদানের কোন নজির বাংলাদেশে নেই। দেশে প্রচলিত ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ২৭২ ও ২৭৩ ধারায় খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অভিযোগে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারো কারাদণ্ড হয় না। যেহেতু বর্তমানে ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো ভোক্তা সংরক্ষণ আইন, নিরাপদ খাদ্য আইন এবং বিএসটিআই অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয় এবং যেহেতু এখানে শাস্তির বিধান কম বরং জরিমানা আদায়ের বিধান বেশি তাই এই আইনে পরিচালিত আদালত সাধারণত কাউকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত না করে কেবল অর্থদণ্ড বা জরিমানা করেন। টাকা দিয়ে খালাস পাওয়া যায় বিধায় এই ধরনের অপরাধীরা কোন শিক্ষা লাভ করে না বরং অধিক অর্থ উপার্জনের জন্যে নতুন নতুন কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে এবং মানুষের খাবারে বিষ ও ভেজাল মেশায়। কারণ এই ভেজালকারীরা জানে, টাকা থাকলে আইন তাদের কিছু করতে পারবে না। এই মনস্তত্ত্বটি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের প্রচলিত বিশুদ্ধ খাদ্য আইনকে যুগোপযোগী করা দরকার।

বিশ্বের প্রায় সব দেশে খাদ্যে ভেজালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। একজন সন্ত্রাসী একজনকে হত্যা করলে একবারেই তার মৃত্যু হয়, আর খাদ্যে ভেজালের কারণে পুরো জাতিকে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়। এ কারণে কেউ খাদ্যে ভেজাল দিয়েছে প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মুনাফালোভীরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে, জরিমানা তাদের কাছে একেবারেই সামান্য। এ কারণে জেল-জরিমানাকে তোয়াক্কা করে না। বিশেষ করে ভোক্তা অধিকার আইন ও নিরাপদ খাদ্য আইন এর প্রয়োগ আরও কঠোর হওয়া দরকার যাতে ভোক্তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। আইনে গণমাধ্যমে ভেজাল এবং দূষিত পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার বিধান থাকা দরকার।

একটা সময় ছিল যখন প্রচারমাধ্যমে সিগারেট ও তামাকজাত পণ্যের মন ভুলানো বাহারী সব বিজ্ঞাপন প্রচার হতো কিন্তু বর্তমানে তা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারের এই সামান্য উদ্যোগটির ফলে দেশের কোমলমতি উঠতি বয়সীদের মধ্যে তামাকজাত পণ্য ব্যবহারে নিরুৎসাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই অভিজ্ঞতাটি আমরা ভেজাল ও মানহীন খাবারের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে পারি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টিভি, ও রেডিওগুলোতে বিভিন্ন পানীয়, শিশুখাদ্যসহ বিভিন্ন খাদ্য ও প্রসাধনীর রমরমা বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। বিজ্ঞাপনগুলো এত সুন্দরভাবে তৈরি যে সহজেই তা মানুষকে আকৃষ্ট করে। ফলে প্রতিদিন দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এসব বিজ্ঞাপনের প্রভাবে প্রতারিত হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুরা এসব বিজ্ঞাপন দেখে এবং ঐ চমকদার খাবারটি খাবার জন্যে জিদ ধরে। অসহায় বাবা-মা তখন বাধ্য হয়ে শিশুকে ঐসব অস্বাস্থ্যকর, ভেজাল এবং দূষিত রং ও কেমিক্যাল মেশানো খাবার কিনে দিতে বাধ্য হয়। প্রক্রিয়াটি এমন নিখুঁত এবং শৈল্পিক যে একজন অভিভাবক অবুঝের মত নিজে তার সন্তানকে হত্যার সামগ্রী কিনে দেন।

শুধুমাত্র বাহারী ও চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুদ্ধ হয়ে খাদ্যপণ্য ক্রয় করলে প্রতারিত হবার ঝুঁকি বেশি থাকছে তার সতর্কতা অবলম্বনে ভোক্তাদের সচেতনতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ ভোক্তা ও কোমলমতি শিশুদের মাঝে সচেতনতা বিকাশে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মনোজগতের এই উপনিবেশ ধারা রুখে দেয়ার ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রের হাতেই রয়েছে। রাষ্ট্রকেই এর জন্যে এগিয়ে আসতে হবে। আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ যেমন জরুরি তেমনি গণসচেতনতা সৃষ্টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞাপনের লোভে খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে প্রকৃত তথ্য ও সংবাদ প্রকাশে বাধা দেয়া, ভেজালের পক্ষে সাফাই সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থেকে জাতিকে প্রকৃত তথ্য জানাতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও পাঠ্যবইগুলোতে জাঙ্কফুডের মতো অনিরাপদ খাদ্যপণ্য, ভোক্তা অধিকার সুরক্ষার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

মানবকণ্ঠ- ২৩-০৪-২০২৩