‘পরিবেশ অধিকার’ ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করণীয়

।। আনিস রায়হান ।।

খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ ১৯৪৮-এর ২৪ ও ২৫ নং অনুচ্ছেদে এ পাঁচটি মৌলিক অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এগুলোকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। এখানকার সংবিধান অনুযায়ী এদের মৌলিক চাহিদা হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মৌলিক চাহিদা বলা হলে, এর ঘাটতি বা অপ্রাপ্যতায় সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করা যায় না, ক্ষতির প্রতিকার মেলে না। কিন্তু অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেলে এটি নিশ্চিত না হলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া যায়। তবে মৌলিক চাহিদার স্বীকৃতিও নির্দেশ করে যে, রাষ্ট্রকে জনগণের এসব চাহিদা পূরণের দায়িত্ব পালন করতে হবে।

কনজুমার্স ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বজুড়ে ভোক্তার মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্র হিসেবে যে বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছে তা হলো, মৌলিক চাহিদার সন্তুষ্টির অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, জানার অধিকার, পছন্দ করার অধিকার, ভোক্তা শিক্ষা অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার। এছাড়া স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও কাজ করার অধিকারের বিষয়টি স্বীকৃতি পেয়েছে জাতিসংঘের ভোক্তা অধিকার সনদে।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছে, তাই সংবিধানে মৌলিক চাহিদাগুলোকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানের দাবি উঠেছে। পাশাপাশি আরও দাবি করা হচ্ছে যে, পরিবেশকে মৌলিক অধিকারের বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। বিশ্বজুড়ে এই দাবী ইতোমধ্যে অনেক দেশে প্রতিষ্ঠিত।

জাতিসংঘ মনে করে পরিবেশের বিষয়টি মানবাধিকারের সঙ্গে যুক্ত। এ বিষয়ে সংস্থাটি দুটি প্রস্তাবও গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘ এখন মানবাধিকার ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক পর্যালোচনার জন্য গবেষণা পরিচালনা করছে। উল্লেখ্য, পাঁচটি মৌলিক অধিকারকে জাতিসংঘ অনেক আগেই মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে, যা শুরুতেই বলা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন, সুস্থ ও টেকসই পরিবেশ উপভোগ মানবাধিকারের সঙ্গে নিশ্চিতভাবে সম্পর্কিত। মৌলিক অধিকারের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে তিনটি সরাসরি সুস্থ পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত। এগুলো হলো, খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থান।

সুস্থ পরিবেশের অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে নিরাপদ খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করা যায় না। নিরাপদ বাসস্থানের অর্থ হলো স্বাস্থ্যকর বাসস্থান, স্বাস্থ্যকর জনপদ, স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র; পরিবেশ অধিকার সংরক্ষিত না হলে বাসস্থানের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা যায় না।

চিকিৎসাও একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু এর দুটি দিক রয়েছে, প্রতিকার ও প্রতিরোধ। রোগাক্রান্ত হওয়ার পর সুচিকিৎসা দেয়া নয়, বরং রোগ-বালাই আগেভাগে প্রতিরোধ করে মানুষের সুস্থতা সবচেয়ে ভালোভাবে নিশ্চিত করা যায়। সেজন্য অবশ্যই স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যেই নদী, জলাশয়, হ্রদ, পাহাড় ও বনভূমিকে ‘জীবন্ত প্রাণ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এদের আইনি অধিকার ঠিক মানুষের মতোই হবে বলে বিভিন্ন দেশের আদালতে রায়ও এসেছে। এগুলোর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিবেশকে রক্ষার ওপরই জোর দেয়া হয়।

বাংলাদেশ এখন নানা সূচকে পৃথিবীর অন্যতম দূষিত দেশ। এটা ঠেকাতে সাংবিধানিকভাবে পরিবেশকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। জনগণের সুস্থভাবে জীবন যাপন ও বিকশিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতেও এর কোনো বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এখানে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

পরিবেশ অধিকার রক্ষার মাধ্যমে আমরা কেবল নিজেদের ভালো থাকা নিশ্চিত করাই নয়, বরং ভবিষ্যত প্রজন্ম ও গোটা পৃথিবীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি। পরিবেশ অধিকারের স্বীকৃতি আদায় ও তা বাস্তবায়নে তাই সকলকে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানাই।