চট্টগ্রামে এলএনজিই ভরসা

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: চট্টগ্রামে গৃহস্থালী ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা গত পাঁচ বছরে পুরোপুরি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) নির্ভর করে ফেলা হয়েছে। জাতীয় গ্রিড থেকে এখন কার্যত চট্টগ্রামের পাইপালাইনে গ্যাস আসার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে কক্সবাজারের মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনালই এখন চট্টগ্রামে গ্যাস পাবার একমাত্র ভরসা।

কিন্তু এই একমাত্র ভরসা এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে, চট্টগ্রামে পরিস্থিতি কী হবে- গত দুই দিনে এমন একটি চিত্র দেখিয়ে দিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। চট্টগ্রামের লাখো বাসায় চুলা জ্বলেনি, ফিলিং স্টেশনের সামনে পড়েছিল গাড়ির দীর্ঘ সারি। রাস্তায় গণপরিবহন কমে যাওয়ায় যাত্রীদের ভোগান্তি, কল কারখানায় উৎপাদনে ব্যাঘাতসহ গ্যাসের জন্য পুরো চট্টগ্রামজুড়ে সৃষ্টি হয় হাহাকার।

দুই দিন পর সোমবার (১৫ মে) থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, তবে চাপ খুবই কম। কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসেব করে দেখেছে, দুই দিনের সংকটকে পুঁজি করে চুলা, কেরোসিন, গ্যাস সিলিন্ডার, রাইস কুকার ব্যবসায়ী আর গণপরিবহনের চালক-মালিকরা চট্টগ্রামবাসীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ২০০ কোটি টাকারও বেশি।

গ্যাস সংকটের শুরু যেভাবে

ঘূর্ণিঝড় মোখা’র আঘাতের আশঙ্কায় গত শুক্রবার (১২ মে) কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান দু’টি এলএনজি টার্মিনাল গভীর সমুদ্রে সরিয়ে নেয়া হয়। এর ফলে ওইদিন রাত ১১টা থেকে পাইপলাইনে এলএনজি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। শনিবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম নগরীসহ কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ আস্তে আস্তে কমতে থাকে। সকাল ৮টার দিকে সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

আকস্মিক সংকটে চট্টগ্রামে গ্যাসের জন্য হাহাকার সৃষ্টি হয়। গ্যাস নির্ভর কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে চট্টগ্রামে লোডশেডিং বেড়ে যায়। সিইপিজেডে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। একই পরিস্থিতি চট্টগ্রামের অধিকাংশ কলকারখানায়ও।

নগরীর ফিলিং স্টেশনগুলো থেকে গাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে শনিবার বেলা গড়াতেই চট্টগ্রাম হয়ে পড়ে অটোরিকশাসহ সিএনজিচালিত গণপরিবহনশূন্য। এর ফলে কর্মস্থলে ও গন্তব্যে যাতায়াতে নগরবাসীকে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া গুনতে হয়েছে।

দৃশ্যমান ভোগান্তিতে পড়েন চট্টগ্রাম নগরীতে বসবাস করা পরিবারগুলো, যাদের চুলা জ্বালানোর বিকল্প কোনো উপায় নেই। তারা ছুটেছেন বিকল্প চুলা, গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে। হোটেল-রেস্তোঁরায় খাবার কিনতে গিয়েও বিপত্তি। অনেক প্রতিষ্ঠান রান্না করতে না পেরে বন্ধ করে দেয়া হয়। যেগুলো খোলা ছিল, সেগুলো দাম ছিল বেশি।

গ্যাস সংকটে দুর্ভোগের একটি চিত্র মিলেছে নগরীর লালখান বাজার এলাকার বাসিন্দা উম্মে রায়হান সিজারের অভিজ্ঞতা বর্ণনায়। তিনি বলেন, ‘রোববার সকালে এক রেস্তোরাঁয় পরোটা আনতে গিয়ে ১০৫ নম্বর সিরিয়াল পেলাম। ছুটে গেলাম কনফেকশনারিতে, বন-পাউরুটি শেষ। কেরোসিনের লিটার বিক্রি হতে দেখলাম আড়াই’শ টাকা। বৈদ্যুতিক চুলা কিনতে ভিশন’র শোরুমে গিয়ে দেখি মানুষ গিজগিজ করছে, চুলা শেষ।’

‘একজন বিক্রয়কর্মী জানালো ঘন্টাখানেকের মধ্যে কিছু চুলা আসতে পারে। নির্ধারিত সময়ের আগেই চুলা এলো, গাড়ি থেকে নামতে নামতেই বিভিন্নজন তা দখলে নিয়ে নিচ্ছিল। তাকিয়ে রইলাম শুধু। হতাশা গ্রাস করলো। এমন অরাজক পরিস্থিতি তো এই বয়সে আর দেখিনি।’

এই পরিস্থিতি রোববার (১৫ মে) দিনভর ছিল, সোমবার সকালেও ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট ছিল কেজিডিসিএল’র কর্মকর্তারা এই সংকট নিয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করেননি। তারা বিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায় সেরেছেন। কিন্তু কবে নাগাদ গ্যাস সংকটের সুরাহা হতে পারে বা বিকল্প কোনো পদ্ধতি আছে কি না- এসব বিষয় নগরবাসীর সামনে তুলে ধরেননি।

মোখা যাবার পর কিছুটা স্বস্ত্বি মিলেছে

ঘূর্ণিঝড় মোখা রোববার (১৪ মে) রাতে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে। আবহাওয়া অধিদফতর রাতেই ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত জারি করে। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর সোমবার সকাল ৮টার পর থেকে নগরীর কিছু কিছু এলাকায় গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়।

নগরীর ঘাটফরহাদবেগ এলাকার বাসিন্দা সুজিত সেন বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টার দিকে গ্যাস এসেছে। তবে প্রেশার একেবারে কম। তারপরও রান্না করা যাচ্ছে। দুই দিন হোটেল থেকে কিনে বাসায় সবাই ভাত খেয়েছি।’

সকালে আসকার দিঘীর পশ্চিম পাড়ের একটি বস্তির বাসিন্দা জান্নাত মণি ও ইয়াসমিন নামে দুই গৃহবধূকে দেখা যায় রাস্তার পাশে ইট দিয়ে চুলা বানিয়ে কাঠ জ্বালিয়ে রান্না করছেন। জান্নাত মণি বলেন, ‘ছোট ছোট বাচ্চাদের তো না খাইয়ে রাখতে পারি না। লাকড়ির যে দাম! ৫৭০ টাকা। তারপরও কিনতে হয়েছে। কী করব, নিজেরা না খেয়ে থাকতে পারি, বাচ্চাগুলো কী সহ্য করতে পারে?’

আসকার দিঘীর পাড়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে দুপুর ১টার পর। স্থানীয় সালাম ভিলার বাসিন্দা প্রবাল বড়ুয়া বলেন, ‘গ্যাস আসার পর রান্না বসানো হয়েছে। ব্যালকনিতে কোরোসিনের স্টোভ জ্বালিয়ে দুই দিন কিছু কিছু রান্না হয়েছিল। লাকড়ির চুলা জ্বালানোর সুযোগ নেই, বাড়ির মালিকের নিষেধ আছে।’

কেজিডিসিএল’র বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (উত্তর) প্রকৌশলী মো. শফিউল আজম খান বলেন, ‘একটা এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। আমরা প্রথমে গৃহস্থালী সংযোগ যেখানে আছে, সেটা নিশ্চিত করছি। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। যারা সঞ্চালন লাইনের নিকটবর্তী তারা একটু আগে পাচ্ছেন, বাকিদের প্রেশার একটু কম। পাইপলাইন একেবারে ফাঁকা। পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সে জন্য আরও ২-৪ দিন সময় লাগতে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পখাতেও গ্যাস সরবরাহ বিকেল থেকে আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে।’

দুই দিনে ২০০ কোটি টাকা লুট!

গ্যাস সংকটের মধ্যে বাসায় রান্নার বিকল্প ব্যবস্থা করতে বাঁশখালীর একটি কলেজের শিক্ষিকা রাজশ্রী দাশ যান নগরীর তিন পোলের মাথায় গোলাম রসুল মার্কেটে। কয়েকটি দোকান ঘুরে একটি কেরোসিনের স্টোভ কিনেন ২২০০ টাকায়।

ক্ষুব্ধ রাজশ্রী দাশ বলেন, ‘দেশটা মনে হয় মগের মুল্লুক হয়ে গেছে ! দোকানদার নিজেরাই বলছে- এসব স্টোভের দাম ৮০০-৯০০ টাকা। আবার তারাই আড়াই হাজার টাকার নিচে বিক্রি করছেন না। সুযোগ পেয়ে ১০০০-১২০০ টাকা বাড়তি নিয়ে নিল।’

নগরীর চকবাজার থেকে বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মাহমুদুল করিম এক বার্নারের গ্যাসের চুলা কিনেছেন তিন হাজার টাকায়। তিনি জানালেন, স্বাভাবিক সময়ে এসব চুলা ১৪০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।

জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যমতে, এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে তিন থেকে চার হাজার টাকায়। অথচ সরকার নির্ধারিত ১২ কেজি এলপিজি গ্যাসের মূল্য এক হাজার ১৭৬ টাকা। সিলিন্ডারসহ সাধারণ সময়ে এই দাম থাকে এক হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। প্রতি লিটার কেরোসিন বিক্রি হয়েছে ১৬০ থেকে ২২০ টাকার মধ্যে। অথচ সরকার নির্ধারিত কেরোসিনের দাম হচ্ছে ১০৯ টাকা।

গোলাম রসুল মার্কেটের একটি দোকানের ব্যবস্থাপক রনি চৌধুরী বলেন, ‘আমরা স্টোভ-বার্নার বিক্রি করি না। কিন্তু এই মার্কেটের সব স্টোভ-বার্নার রোববার সকালের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ লাইন ধরে কিনেছে।’

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, ‘গ্যাস সংকটের মধ্যে দুই দিন আমাদের টিম বাজার পরিস্থিতি যাচাই করেছে। গ্যাস সংকটের কারণে একটি পরিবারকে হোটেল-রেস্তোঁরা থেকে খাবার কিনতে হয়েছে, স্টোভ কিংবা গ্যাসের চুলা, কেরোসিন অথবা সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে হয়েছে। গণপরিবহন সংকটের কারণে বাড়তি ভাড়ায় পরিবারের সদস্যদের গন্তব্যে যেতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সবক্ষেত্রেই বাড়তি টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন গ্রাহকরা। এভাবে আমরা হিসেব করে দেখেছি, প্রতিটি পরিবার দুই দিনে চার হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে বাধ্য হয়েছে। কেজিডিসিএল’র গৃহস্থালী গ্রাহক প্রায় ছয় লাখ। তাহলে আমাদের হিসেবে সবমিলিয়ে প্রায় ২৩৮ কোটি টাকা শুধু দুই দিনে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে বাজার থেকে তুলে নিয়েছে।’

গ্যাস সংকটকে পুঁজি করে লোকজনকে জিম্মি করার প্রমাণ মিলেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্তের অভিযানেও। গত দুই দিনে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোট ১১টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

রোববার (১৪ মে) রাতে নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশন সংলগ্ন তাহের স্টোরকে ২০ হাজার, সোহেল স্টোরকে পাঁচ হাজার, এনায়েত বাজারে কিচেন ট্রেডার্সকে ১০ হাজার এবং আরও তিনটি দোকানকে মোট ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান তিন থেকে চার হাজার টাকায় ১২ কেজি এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি করছিল।

একই অভিযোগে সোমবার নগরীর লাভ লেনের হাবিব ট্রেডার্সকে ১০ হাজার টাকা, এনায়েত বাজার মোড়ে জে এস ট্রেডিংকে ২০ হাজার টাকা এবং আরিফ ট্রেডার্সকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর নগরীর গোলাম রসুল মার্কেটে ইনডাকশন চুলা ও রাইস কুকারের দাম বেশি রাখায় দুটি দোকানকে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সাময়িক গ্যাস সংকটকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে এবং বাজারে গ্যাসের সিলিন্ডারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। রাইস কুকার, ইনডাকশন চুলা ও ইনফ্রারেড চুলার দাম বাড়িয়ে দেয়।’

চট্টগ্রামের ভরসা শুধুই এলএনজি

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, দেশের জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে ২০১০ সালে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৭ সালে নির্মাণ, পরিচালনা ও স্থাপন (বিওওটি) পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন করে। আমদানি করা এলএনজি ওই টার্মিনাল থেকে সরবরাহ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১৯ অগাস্ট। ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই টার্মিনাল থেকে ৫১ লাখ আট হাজার ৪৮০ দশমিক ৫১ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়েছে।

এর পাশেই দ্বিতীয় টার্মিনাল স্থাপন করে দেশীয় সামিট গ্রুপ ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে এলএনজি পাইপলাইনে সরবরাহ শুরু করে। ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই টার্মিনাল থেকে চার লাখ ১৩ হাজার ৩৫ দশমিক ৯৭ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়েছে।

সূত্রমতে, চট্টগ্রামে একসময় কুমিল্লার বাখরাবাদ, ফেনী বা সিলেট অঞ্চলের গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডের চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ হতো। কিন্তু এলএনজি আমদানি শুরুর পর জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। মহেশখালী থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত ৩০ ও ৪২ ইঞ্চির দু’টি পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। ভাসমান টার্মিনাল থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আনোয়ারায় এনে জাতীয় গ্রিডের মূল সরবরাহ লাইনে দেয়া হয়। ভাসমান টার্মিনাল থেকে পাইপলাইনে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ২৭০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহ করা হয়।

চট্টগ্রামে কেজিডিসিএলের মোট গ্রাহক-সংযোগ ছয় লাখ এক হাজার ৯১৪টি। এর মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ পাঁচ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি, বাকিগুলো শিল্প-বাণিজ্যসহ অন্য খাতে। এসব খাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। ভাসমান টার্মিনাল থেকে সরবরাহের হিসেবে চট্টগ্রামে দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি অন্তত ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট।

কেজিডিএসএল’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস নিতে পাইপলাইনের বাল্বগুলো এমন ভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে গ্যাস শুধু জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যায়। জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামের পাইপলাইনে গ্যাস আনার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

কেজিডিসিএল’র বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (উত্তর) প্রকৌশলী মো. শফিউল আজম খান বলেন, ‘আপাতত যে সিস্টেম আছে, গ্রিড থেকে এদিকে গ্যাস আসে না। এখন শতভাগ এলএনজি নির্ভরই অনেকটা বলা চলে। টেকনিক্যাল কারণেই আসে না। এলএনজি আনতে গিয়ে নতুন যে পাইপলাইন বসাতে হয়েছে, সেখানে কনফিগারেশন অনেকটা চেঞ্জ করতে হয়েছে, মডিফিকেশন করতে হয়েছে। সুতরাং সিস্টেমটা এমন হয়ে গেছে যে, পাইপলাইনে এখন আর গ্রিড থেকে গ্যাস আসে না।’

কেজিডিসিএল’র ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মু. রইস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘২০১৮ সালের পর থেকে চট্টগ্রামে জাতীয় গ্রিড থেকে কোনো গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে না। এর ফলে চট্টগ্রাম এখন পুরোপুরি এলএনজি বেইজড বলা যায়। জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে না মানে, সেখানেও তো গ্যাসের চাহিদা আছে। চাহিদার বেশি গ্যাস তো আর পাইপলাইনে নেই। সুতরাং ন্যাশনাল গ্রিড থেকে যদি আসার সময় প্রেশার কমে যায়, সেটা তো চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছাবে না।’

প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি’র বিষয়টা তো ভিন্ন আলোচনা। সম্ভাবনা তো যেকোনো কিছুই হতে পারে। সেই আলোচনা তো এখন উঠছে না। পাইপলাইন তো আছে। আগে পাইপলাইন দিয়ে তো ন্যাশনাল গ্রিড থেকে গ্যাস এসেছে। সে রকম পরিস্থিতি হলে নিশ্চয় বিকল্প একটা উপায় বের করা হবে।’

বিকল্পবিহীন এলএনজি নির্ভর গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে নগরীর সচেতন মানুষের মধ্যে যুগপৎ ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রাজধানীতে বসে যারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা শুধু ঢাকাকেই বাংলাদেশ ভাবে। আর সব মফস্বল। কী মারাত্মক ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম? প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিংবা আমদানি সংকটে চট্টগ্রামে চুলা থেকে শিল্প সব অচল থাকবে, দীর্ঘায়িত হলে আলো-পানিও থাকবে না। গত দুই দিন চট্টগ্রামের কত মানুষ না খেয়ে ছিল, তার পরিসংখ্যান কি কখনো মিলবে?’

ক্যাব’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, ‘এই পরিস্থিতির দায় সম্পূর্ণ সরকারের নীতিনির্ধারক আর কেজিডিসিএল’র। গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাকে যখন শুধু এলএনজি নির্ভর করে ফেলা হচ্ছিল, তখন তারা কী আজকের পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেছিল? রাখেনি। এমন অদূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়ে যারা লাখ, লাখ মানুষের জন্য দুর্ভোগ তৈরি করল, দায় তাদের অবশ্যই নিতে হবে।’

কেজিডিসিএল’র সামনে অবস্থান কর্মসূচি

গ্যাস সংকটে ভুক্তভোগী লোকজন নগরীর ষোলশহরে কেজিডিসিএল কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। সোমবার (১৫ মে) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালান করা হয়। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।

ভুক্তভোগীরা বলেন, ‘মহেশখালীর ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় দুই দিন চট্টগ্রামে আমরা গ্যাস পাইনি। নিদারুণ কষ্টে নগরবাসী দিনাতিপাত করছে। শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। যদি এভাবে কয়েকদিন পর পর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় কিংবা পাইপে লিকেজ হয় তবে চট্টগ্রামের মানুষকে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হবে। আমাদের দাবি হচ্ছে, এলএনজি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে চট্টগ্রামকে জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস সরবরাহ করতে হবে।’

‘চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে’ সাংবাদিক বিপ্লব পার্থের সভাপতিত্বে অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন জাফর, সৌরভ প্রিয় পাল, রাসেল উদ্দিন, সাজ্জাদ হোসেন, মো. ফোরকান, জিয়া উদ্দিন আহমেদ, মো. ফিরোজ, মিঠুন বৈষ্ণব, শরিফুল ইসলাম জুয়েল, মো. রুবেল।