দেশে তরল জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সারা বিশ্ব যেখানে ক্রমেই জীবাশ্ম-জ্বালানির ওপর নির্ভরতা থেকে সরে আসছে, সেখানে দেশে এর পরিমাণ ক্রমাগত ভাবে বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) আগামী ১০ বছর পর জ্বালানি তেলের আমদানি বৃদ্ধির যে চিত্র সরকারের কাছে দিয়েছে, তাতে দেখা গেছে আগামী ১০ বছরে ডিজেলের আমদানি বাড়াতে হবে ২৯ লাখ ৩৮ হাজার টন।

বিশ্বের মোট জ্বালানি চাহিদার বেশির ভাগই যোগান দেয় ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম-জ্বালানি; বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক জ্বালানি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত অনিশ্চিত জ্বালানি নিরাপত্তা, পরিবেশ দূষণ এবং তেলভিত্তিক ভূ-রাজনীতির কারণেই বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সাল নাগাদ তাদের মোট আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ ভাগ বিকল্প জ্বালানি দ্বারা প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

এ বছর নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ (জলবায়ু সম্মেলন) সম্মেলনেও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে চুক্তি করার দাবি উঠেছে। মিশরে চলা জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে এই প্রস্তাব তোলেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ টুভ্যালু। টুভ্যালুর প্রধানমন্ত্রী কাউসিয়া নাতানো জলবায়ু সম্মেলনে এ দাবি করেন।

জানা যায়, এই চুক্তিটি হচ্ছে একটি প্রস্তাবিত চুক্তি, যেখানে স্পষ্ট ভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার না বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। এর লক্ষ্য মূলত কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহারের পরিবর্তে ‘ক্লিন এনার্জি’ বা পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে ফেরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের সব চাইতে বেশি ব্যবহার হয় পরিবহন এবং সেচে। সরকার যদি এই দুই খাতে জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারে সেক্ষেত্রে এই চিত্র উল্টে যেতে পারে। এজন্য সরকারের তরফ থেকে গ্রিন এনার্জির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সৌর, বায়ুর মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, ক্লিন এনার্জির বিস্তারে সরকার পরিকল্পনা অনুসারে এগুচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করা হবে। বাংলাদেশ এমনিতেই কার্বন ইমিশন কম করে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫ ভাগ পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষিখাতে ১১ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়েছে। যা মোট ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ১৬ দশমিক ৬৪ ভাগ। আসন্ন ২০২২-২০২৩ সালের কৃষি সেচ মৌসুমে ডিজেল ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ১২৯ মেট্রিক টন ও লুব অয়েল ৪৫ হাজার ৯৭১ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল প্রয়োজন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকার কৃষি সেচে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়ার মধ্যে এভাবে কৃষিতে তেলের চাহিদা বেড়ে যাওয়াকে আশঙ্কাজনক বলে মনে করা হচ্ছে।

২০৩০ সালের পর্যন্ত তেলের যে চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৯ লাখ ৬১ হাজার ৬৩৫ টন ডিজেল আমদানি করা হয়েছে; যা ২০৩০-২০৩১ অর্থবছরে বেড়ে হবে ৬৯ লাখ টন।  ২০২১-২২ এ জেট ফুয়েল আমদানি করা হয় চার লাখ ১০ হাজার ৯৮২ মেট্রিক টন যা ১০ বছরে বেড়ে হবে ছয় লাখ ৯০ হাজার টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে অকটেন আমদানি করা হয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ৫১৪ টন যা ১০ বছরে উন্নীত হবে ছয় লাখ ৩০ হাজার টন। 

২০২১-২২ অর্থবছরে ফার্নেস অয়েল আমদানি করা তিন লাখ ১৬ হাজার ৮৬ টন; যা ১০ বছর পর হবে অর্থবছরে পাঁচ লাখ টন। মেরিন ফুয়েল ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছে ১৬ হাজার ৫০৬ টন; যা বেড়ে ২০৩০-৩১ অর্থবছরে দাঁড়াবে দুই লাখ ৩০ হাজার টন। তবে নতুন রিফাইনারি না হলে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি ১৫ হাজার মেট্রিক টনের ঘরেই ঘোরাফেরা করবে।

তবে সরকার সম্প্রতি বেসরকারি খাতকে জ্বালানি তেল আমদানি, পরিবহন এবং খুচরা বিক্রির অনুমতি দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে যদি দেশে কোনও নতুন তেল পরিশোধনাগার গড়ে ওঠে তাহলে এই চিত্র বদলে যাবে। যদিও রিফাইনারিতে বিনিয়োগকে দীর্ঘমেয়াদি বিবেচনায় এখন আর দেশে দেশে নতুন রিফাইনারি স্থাপন করা হচ্ছে না। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে জ্বালানি ব্যবহারের ধরনে পরিবর্তন আসছে। আগামী ২০ বছরের মধ্যে বিশ্ব নতুন জ্বালানিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। তখন এসব রিফাইনারি বেকার বসে থাকবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি সরকারের কাছ থেকে আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়- আগামী ১০ বছর পর জ্বালানি তেলের চাহিদা কেমন হবে। আমরা সেটি তৈরি করে পঠিয়েছি। এটি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, প্রথমত জীবাশ্ম জ্বালানি একটি সীমিত সম্পদ। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এটি আমদানি করে থাকে। এতে আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে থাকে। এদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদ দেশীয় সম্পদ, আনলিমিটেড রিসোর্স। যা আমাদের সিকিওর এনার্জি দেবে। দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে একটা দেশের উচিত ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়া, আর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা।

তিনি বলেন, এই বাইরে জীবাশ্ম জ্বালানির যে দূষণ, এর কারণে আজ পুরো বিশ্ব হুমকির মুখে। এবারের জলবায়ু সম্মেলন থেকে শুরু করে সব জায়গায় এখন এনার্জি ট্রানজিশন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সারা বিশ্ব যখন এনার্জি ট্রানজিশন করে রিনিউয়েবলে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের মতো নাতিশীতোষ্ণ দেশ হয়ে রিনিউয়েবল না বাড়িয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়াই তাহলে রিনিউয়েবলে আমাদের যে অপরচুনিটি আছে সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। এতে করে আমরা লাগাতার দূষণের দিকে যাব।