কাপড়ের রং মেশানো খাবার খাওয়াচ্ছে ‘কাচ্চি ভাই’

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: ফুড গ্রেডের নামে প্রতারণা করে খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে কাপড়ের রং, যা কিডনি ও ক্যান্সারসহ নানা মরণব্যাধির জন্য দায়ী।

ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নামিদামি খাবারের প্রতিষ্ঠানগুলো হরহামেশাই ব্যবহার করছে কাপড়ে ব্যবহৃত রং, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন কেমিক্যাল ‘ফুড গ্রেড’ খাদ্যে মেশানো হয়। কিন্তু দেশে ফুড গ্রেডের নামে প্রতারণা করে অধিকাংশ খাদ্যসামগ্রীতে কাপড়ের রং মেশানো হচ্ছে। তাই আমরা খাবারের নামে খাচ্ছি বিষাক্ত কেমিক্যাল।

সোমবার রাজধানীর বেইলি রোডে ‘কাচ্চি ভাই’ নামের একটি রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযানের নেতৃত্ব দেন ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান, সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল, সহকারী পরিচালক তাহমিনা বেগম।

নামিদামি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে ‘কাচ্চি ভাই’ খাবারে মেশাচ্ছিল ক্ষতিকর কাপড়ের রং। যা হাতেনাতে ধরেছে ভোক্তা কর্মকর্তারা। রাজধানীতে কাচ্চি ভাই’র বেশ কয়েকটি শাখা রয়েছে।

‘কাচ্চি ভাই’ এ ভোক্তার অভিযান
ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের খবরে কাপড়ে ব্যবহারের রংয়ের ডিব্বা ময়লার ডাস্টবিনে ফেলে দেন কাচ্চি ভাইয়ের কর্মরত একজন। সেটি দেখে ফেলেন ভোক্তা কর্মকর্তা। সসের ডিব্বার মধ্যে রাখা হয়েছে এসব রং। ময়লার ডাস্টবিন থেকে ফেলে দেওয়া রংয়ের ডিব্বা বের করে আনেন ভোক্তা কর্মকর্তা। এর পর কাচ্চি ভাই’র দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার এটাকে ‘ফুড গ্রেড’ রং হিসেবে দাবি করেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই রং দুটি গ্লাসে ঢেলে দায়িত্ব থাকা ম্যানেজার এবং তার সহকারীকে খেতে বলেন ভোক্তা কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার মণ্ডল। যেহেতু ফুড গ্রেড সেহেতু খেলে ক্ষতি হবে না। তবে সরাসরি গ্লাসে খেতে রাজি হননি তিনি। পরে কাচ্চির সঙ্গে মিশিয়ে খেতে বলা হয়। তাতেও রাজি হননি। অতপর নিজ মুখে স্বীকার করেন এগুলো কাপড়ে ব্যবহারের রং। যা ফুড গ্রেড বলে ক্রেতাদের খাইয়ে আসছিলেন

এছাড়া ফ্রিজের মধ্যে রান্না করা খাবার এবং কাঁচা খাবার পাওয়া যায়। সবশেষ ভোক্তা কর্মকর্তাদের কাছে নিজেদের ভুল স্বীকার করেন কাচ্চি ভাই এর দুই কর্মকর্তা।

জরিমানা
ভোক্তা স্বার্থবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় কাচ্চি ভাইকে ভোক্তা অধিকার আইনের দুই ধারায় দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া জব্দকৃত রং ধ্বংস করা হয়।

আরও অভিযান
একই ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় রয়েছে ‘এমব্রশিয়া’ নামের আরেকটি রেস্টুরেন্ট। সেখানেও অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর। এই রেস্টুরেন্টে মেয়াদোতীর্ণ সস পাওয়ায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

একই ভবনের ৫ম তলায় ‘হাক্কা ঢাকা’ নামের রেস্টুরেন্টে ভোক্তা স্বার্থবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়ায় পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

যা বলছেন ভোক্তা কর্মকর্তা
অভিযানের বিষয়ে মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, ভোক্তা অধিদপ্তর সর্বদা ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। জরিমানা করা আমাদের মূল লক্ষ্য নয়। কাচ্চি ভাই নামের এই রেস্টুরেন্ট কাপড়ে ব্যবহারের রং খাবারে ব্যবহার করছিল, যা গুরুতর অপরাধ। এসব রং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এই প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যারা এসব রং বিক্রি করছে (খুচরা এবং পাইকারী) সকলের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যহত রয়েছে এবং যারা ফুড গ্রেডের নামে প্রতারণা করে কাপড়ের রং ব্যবহার করছে, তাদের ভোক্তা অধিকার আইনে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

বাংলাদেশ খাদ্য পরীক্ষাগারের তথ্য
বাংলাদেশ খাদ্য পরীক্ষাগারের একটি তথ্যে জানা যায়, ১০০টি খাদ্যের মধ্যে মাত্র দুই একটিতে ফুড গ্রেড ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাকিগুলোতে ফুড গ্রেড ব্যবহারের প্রমাণ মেলেনি। এটা অনেকটা বিপদজনক তথ্য। এছাড়া খাদ্য পরীক্ষাগার বাংলাদেশে বাজারজাতকৃত খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে পরীক্ষাগারে ১০৭ ধরনের খাদ্য পরীক্ষা করে আসছে। যার ৯৮ ভাগই ভেজাল ও বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে সারাদেশে ৪৩টি ভোগ্যপণ্যের (খাদ্যদ্রব্য) মোট ৫৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর এই ৪৩টি পণ্যেই ভেজাল পাওয়া গেছে।

বলছেন চিকিৎসক
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আকরাম হোসাইন বলেন, দেশের ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৩০ ভাগেরই ক্যান্সার হয়েছে খাদ্যে ভেজালের কারণে। এছাড়া পরিবেশগত নানা কারণে ফুসফুসের ক্যান্সার হচ্ছে। দুষিত বাতাসে কার্বন-মন অক্সাইড ও সালফাইল থাকে।

তিনি বলেন, দেশে তেমন কোন স্টাডি নেই, তবে ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রোগব্যাধির মধ্যে ৬ষ্ঠ স্থানে ক্যান্সার।

অধ্যাপক ডা. আকরাম হোসাইন বলেন, আমরা যে খাদ্য খাচ্ছি তা বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো বিষ। এটা নীরবে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্যান্সার সৃষ্টি করছে। বর্তমানে ক্যান্সার রোগী ব্যাপক হারে বাড়ছে। ক্যান্সার হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে এখন প্রায় দুই মাস অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।

কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দেশে খাদ্যে বস্ত্রকলের রং ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পরীক্ষাগারে তথ্যানুযায়ী, খাদ্যে হেভি মেটাল পাওয়া যাচ্ছে-যা আগুনেও নষ্ট হয় না। এতে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ধীরে ধীরে ডেমেজ হয়ে যায়। হেভি মেটাল মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণ করলে কিডনিসহ যেকোনো অঙ্গে ক্যান্সার হতে পারে।