অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে মধ্যবিত্ত আর কত অসহায় হবে?

এস এম নাজের হোসাইন: কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এর তথ্যমতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৭ শতাংশ। সরকারি হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, যা বছরওয়ারি হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু আগস্টেই খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

খাদ্যপণ্যের প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএসের) তথ্যের দ্বিগুণের কম নয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে সারা বিশ্বে যেখানে খাদ্যের দাম কমছে, যা দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, আর বাংলাদেশে সেখানে সরকারি হিসাবেই উল্টো চিত্র। বিবিএসের হিসাবে, একটি পরিবারে যত অর্থ খরচ হয়, তার ৪৮ শতাংশের মতো খরচ হয় খাবার কিনতে। এই কারণে ধারাবাহিকভাবে খাদ্যসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি এবং সেই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বৃদ্ধি না হওয়ার কারণে নির্দিষ্ট ও মধ্য আয়ের মানুষগুলো ভীষণ সংকটে আছে।

আবার এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত দেশব্যাপী ১০ হাজার মানুষের ওপর এক জরিপে ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

ক্যাবসহ ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকরা বারবার বলে আসছেন, বিশ্বে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য যখন কমছে, তখন বাংলাদেশে ধারাবাহিক মূল্যস্ফীতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক মন্দা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে বারবার দায়ী করার সুযোগ নেই। এই মূল্যস্ফীতির পেছনে সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনা, সাধারণ মানুষের সংকটটি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান না করে কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার যোগ সূত্র আছে।

মূল্যস্ফীতির পেছনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বারবার মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যহ্রাস, আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজারে পণ্য সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো ইত্যাদির বিষয়গুলোর প্রভাবকে অনেকে দায়ী করছেন। কিন্তু হঠাৎ করে বাজারে দেশীয় উৎপাদিত ডিম, মুরগি, পেঁয়াজ, আলু, ডাল, চিনি, তেল ইত্যাদি নিত্যপণ্যগুলোর চক্রাকারে একেক সময় একেকটির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাগুলো কোনোভাবে পৃথক করা করা যায় না।

বাজারে মুষ্টিমেয় অসাধু ও কর্পোরেট ব্যবসায়ীর একচেটিয়া আধিপত্য, অতিমুনাফা করা এবং তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ না নিয়ে শিথিল থাকা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজারে অতি পরিচতি শব্দ ‘অদৃশ্য হাতের’ কারসাজি। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বারবার বলে আসছেন, বাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম নির্ধারিত হওয়ার কথা, চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাজারে পর্যাপ্ত মজুদ ও আমদানি থাকলেও দাম নির্ধারিত হচ্ছে কিছু ‘অদৃশ্য হাতের’ মাধ্যমে।

বাংলাদেশে ‘অদৃশ্য হাতের’ নির্দেশে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় ঠিকই কিন্তু সেই অদৃশ্য হাতটা অনেক ক্ষেত্রে বাজারের নয়, শুধু গুটিকয়েক কর্পোরেট ব্যবসায়ীর নয়, এখন বড় আকারে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিছু মধ্যস্বত্ত্বভোগী। যারা অনেকে আবার কমিশন এজেন্ট, বেপারী ও আড়তদার হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। যা দেশে উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানি করা উভয় ধরনের পণ্যের বেলায় এই ধরনের ঘটনা বেশ ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা ঠেকাতে সরকার পেঁয়াজ, চিনি ও ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে দেন। প্রায় মাসখানেক হলো, কিন্তু সরকারের সেই দামে পণ্য পাওয়ার দৃষ্টান্তের চেয়ে অধিক দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছে। আবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকরে মাঠ পর্যায়ে বাজার তদারিকর সাথে যুক্ত ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে তৎপর দেখা গেলেও অন্যরা নীরব।

তাদের অনেকে এখন উন্নয়ন মেলা আয়োজন, পর্যটন প্রসারসহ নানা ধরনের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাই সংকটকালীন সময়ে সরকারের মূল্যনির্ধারণ প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। অনেকে আবার এই প্রক্রিয়াটি ভুল বলে আখ্যায়িত করতে পিছপা হচ্ছেন না। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি একটি এডহক প্রক্রিয়া বলা হলেও বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তি সামনে আনা হচ্ছে।

তবে সংকটকালীন সময়ে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি, যেসব পণ্য নিয়ে সংকট তৈরি হয় তার জন্য বছরজুড়ে আমদানি উন্মুক্ত রাখা, আমদানি শুল্ক নির্দিষ্ট না রেখে সংকটকালীন সময়ে এই শুল্ক কমানো এবং দেশে উৎপাদন বাড়লে বাড়ানোর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি করার পদ্ধতি চালু করার ওপর জোর দেওয়া হয়। একইসাথে দেশীয় উৎপাদন ও চাহিদার একটি তথ্য নির্ভর পরিসংখ্যান তৈরির কথা দাবি করা হচ্ছে।

যাই হোক, ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্দেশ মানেন না, এই ঘটনা শুনতে শুনতে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর উদ্যোগে ব্যবসায়ী সম্মেলনে ব্যবসায়ীরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ এবং আবারও প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রাখতে তারা শপথের পুর্নঃব্যক্ত করেন। সেই জায়গায় নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করার জন্য কৃত্রিম সংকট ও অতিমুনাফায় মগ্ন ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থহাসিল, সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রণোদনা, সুদমুক্ত ঋণসহ নানা সুবিধা আদায়ে সকলে মিলে ক্ষমতাসীন দলের গুণকীর্তন করা নতুন বিষয় নয়।

তবে নেওয়ার বেলায় দলমত নির্বিশেষে এক হয়ে সুবিধা নিলেও জনস্বার্থে নির্দেশনা মানতে কেন অনীহা তা খতিয়ে দেখার অবকাশ রাখে। তবে সরকারের ক্ষমতা ও অধিকার অফুরন্ত। তার হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, নানা ধরনের আইন এবং আইন বাস্তবায়নের জন্য রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। তারপরও ব্যবসা ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা, আইনের প্রয়োগ ও সরকারি নির্দেশনা মানাতে সরকার অনেক কিছুতে ব্যর্থ।

বিশেষ করে সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারা অচল করে দেবে। আবার প্রভাবশালী কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলছেন, ‘আলুর সিন্ডিকেট মানুষের টাকা শুষে নিয়েছে, কিছু করতে পারিনি’। তিনি আরও বলেছেন, ‘সিন্ডিকেট করে আলুর কোল্ড স্টোরেজগুলো সাধারণ মানুষের টাকা শুষে নিয়েছে। আমরা অসহায় হয়ে দেখেছি, কিছু করতে পারিনি। আমরা বেশি চাপ দিলে তারা বাজার থেকে আলু তুলে নিয়ে যায়।’

এই ধরনের অসহায়ত্বের কথা বোঝাতে গিয়ে উদ্ধৃতিটি আমাদের হতাশ করেছে। তবে মন্ত্রীদের এইসব মন্তব্য ব্যবসায়ীদের আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনে উৎসাহিত করে।

যাই হোক, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম নিয়ে কারসাজি ও কৃত্রিম সংকট হয়। ডিম উৎপাদনকারীদের দাবি অনুযায়ী, বড় খামারি পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৩১ পয়সা আর ছোট খামারিদের ক্ষেত্রে যা ১০ টাকা ৭৫ পয়সা। প্রথমত, ডিমের এই উৎপাদন খরচ প্রতিবেশী ভারত বা পাকিস্তানের খুচরা বিক্রয়মূল্যের তুলনায় অনেক বেশি।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১টি ডিমের বিক্রয়মূল্য ৫ রুপি ৩৩ পয়সা, যা বাংলাদেশি টাকায় ৭ টাকা ৫ পয়সা আর পাকিস্তানে প্রতিটি ডিমের দাম পড়ে ২৪ দশমিক ৪৭ রুপি, বাংলাদেশি টাকায় যা ৯ টাকার মতো। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডিমের এই বাড়তি উৎপাদন খরচের জন্য দেশে পোল্ট্রি ফিড এবং এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দামও তুলনামূলক বেশি। কারণ, ফিড ও মুরগি বাচ্চা উৎপাদন এই বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে। এমনকি প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ গড়ে সাড়ে ১০ টাকা ধরলেও বিক্রয়মূল্য ১২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়, অথচ আগস্টে ডিমের ১৫ টাকায় ঠেকেছিল।

ডিমের বাড়তি চাহিদা ও কম উৎপাদনের সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেট করে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির এই ঘটনা নতুন নয়। ২০২২ সালের আগস্টেও একইভাবে ডিম উৎপাদনকারী বড় খামারিগুলো কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে মূল্য কারসাজি ও নিলাম প্রক্রিয়ায় নিজেদের নিয়োজিত এজেন্ট ব্যবহার করে ডিমের দাম তোলার সত্যতা পান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি)।

ডিমের ক্রয়মূল্য যা-ই হোক না কেন, ডিম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সমিতিগুলো মুঠোফোনে মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলে। এই বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও এভাবে কারসাজি করে ডিমের মূল্য নির্ধারণে এর পেছনে দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ফলে ডিমের বাজারের কারসাজিও বন্ধ হয়নি।

ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, আমদানিকারক, পাইকারি বিক্রেতারা দিনে দিনে অনেক সবল হয়েছেন। ধনী, ধনাঢ্য হয়েছেন, কেউ কেউ অতিধনী হয়েছেন। এর মধ্যে আছে চাল, ডাল, লবণ, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, আদা, রসুন, সয়াবিন থেকে শুরু করে সব ধরনের নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ী আছেন। এরা নিজেদের টাকায় যতটুকু না বড় হয়েছেন, তারচেয়ে বেশি বড় হয়েছেন ব্যাংক ঋণ ও সরকারি প্রণোদনার টাকায়।

একসময় আমাদের ব্যবসায়ীরা নানা ব্যবসায় পয়সা কামাতেন, বাজারে প্রভাব বিস্তার করতেন, কিন্তু তারা ভোগ্যপণ্য নিয়ে কারসাজি ও সংকট করতেন না। কিন্তু সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কর্পোরেট ব্যবসায়ী গ্রুপ এই খাতে প্রভাব বিস্তার করে সুবিধা নিতে পারায় অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছেন। এখন অধিকাংশ কর্পোরেট গ্রুপ নিত্যপণ্যের বাজারে শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছেন।

আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, পামতেল, চিনি, আটা তৈরির গম, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা ও মটর ডালডাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময়কার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও দেশের বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে অদৃশ্য হাতের কারসাজির লোকজনই যাদের নাম-পরিচয় সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে জানা, তারাই এগুলোর মূল নায়ক।

আবার বাজারের কারসাজির পেছনে দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীদের পরিচয় জানা থাকার পরও যখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তখন সরকার সাধারণ জনগণ ও বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে আসলে কার স্বার্থ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।