১০ রাঘববোয়ালের পেটে ধান চাল

এসএম আলমগীর ও মো. ইসমাইল হোসেনঃ বছরের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এ মুহূর্তে দেশের বাজারে চালের দাম সবচেয়ে কম থাকে। কারণ সবচেয়ে বড় মৌসুম বোরো ধান ওঠে এই সময়, কৃষকের ঘর নতুন ধানে ভরে যায়। ধানের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধানের দাম যেমন কমে, তেমনি কমে চালের দাম। অথচ এবারের চিত্র ঠিক উল্টো। বোরোর ভরা মৌসুমেও ধান ও চালের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ভরা মৌসুমে কেন চালের দাম বাড়ছে সেটিও খতিয়ে দেখতে বলেছেন তিনি।

কিন্তু কেন ভরা মৌসুমে চালের দাম এত বেশি- সময়ের আলোর অনুসন্ধানে বেরিয় এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মূলত ১০ রাঘববোয়ালের কারণেই ভরা মৌসুমেও ধান-চালের বাজার এতটা অস্থির। এর মধ্যে আছেন ৫টি বৃহৎ মিলমালিক এবং ৫টি গ্রুপ অব কোম্পানি। এর পাশাপাশি ধান-চালের বাজারে কালো টাকার প্রবেশের কারণেও বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে পেশাদার ধান-চালের ব্যবসায়ী নন এমন অনেক ব্যক্তি যাদের হাতে অঢেল কালো টাকা রয়েছে- তারাও এখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে ধান কিনতে নেমেছেন। বোরোর অধিকাংশ ধান চলে যাচ্ছে ওই বৃহৎ পাঁচ মিলমালিক, পাঁচ গ্রুপ অব কোম্পানি এবং অপেশাদার ও হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ধান ব্যবসায়ীদের কব্জায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বৃহৎ পাঁচ মিলমালিকের মধ্যে আছে যশোরের মেসার্স মজুমদার রাইস মিল। মিলটির স্বত্বাধিকারী চিত্ত মজুমদার। মিলটি যশোরের নওয়াপাড়ার গুয়াখোলা এলাকায়। এরপর রয়েছে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জের জহুরা অটো রাইস মিল, চাঁপাইনবাগঞ্জের এরফান অটো রইস মিল। এর স্বত্বাধিকারী মো. এরফান আলী। নওগাঁর বেলাল অটো রাইস মিল এবং বৃহত্তর কুষ্টিয়া এলাকার রশিদ গ্রুপের রশিদ অটো রাইস মিল। মিলমালিকদের মধ্যে এই ৫টি প্রতিষ্ঠান দেশের চালের বাজারে বড় একটি অংশ জোগান দিয়ে থাকে। এ জন্য ধানের মৌসুমে এসব মিলমালিক প্রচুর ধান কিনে মজুদ করে।

মিলমালিকদের বাইরে ধান-চালের বাজারে এখন ‘বড় খেলোয়াড়’ ৫টি গ্রুপ অব কোম্পানি। এর মধ্যে রয়েছে- সিটি গ্রুপ, প্রাণ আরএফএল, এসিআই, স্কয়ার গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠান মূলত বিভিন্ন রকমের ভোগ্যপণ্য আমদানি বা উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত চাল বিক্রিতে নেমেছে। এর জন্য এসব প্রতিষ্ঠান দেশের বাজার থেকে প্রচুর ধান কিনে মজুদ করছে।

জানা যায়, ১৯৯৭ সালের দিকে দেশে প্রথম মোড়কজাত সুগন্ধি চাল বাজারজাত করে প্রাণ। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সুগন্ধি চাল মোড়কজাত করে বিপণনে নামে। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানগুলো সুগন্ধি চালের পাশাপাশি রোজকার ভাতের জন্য বিভিন্ন গ্রেডের চালও মোড়কজাত করে বিক্রি করতে শুরু করে। মোড়কজাত এসব চালের দাম কিছুটা বেশি হলেও নিজস্ব বিপণন কৌশলের কারণে ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে এদের চালের বাজার। এ মুহূর্তে দেশের বাজারে রয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপের ব্র্যান্ড পার্বণ, স্কয়ার গ্রুপের চাষি, টিকে গ্রুপের পুষ্টি, এসিআই গ্রুপের পিওর, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রাণ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল গ্রুপের রূপচাঁদা, আকিজ গ্রুপের এসেনশিয়াল, সিটি গ্রুপের তীর, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চাল।

সব বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানই এখন চাল খাতে বড় বিনিয়োগ করছে। এ ছাড়া একাধিক মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান উত্তরবঙ্গভিত্তিক চালের চাতাল ও মিল পর্যায়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রধান এ খাদ্যপণ্যের বাজারে নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে।

এই ১০ রাঘববোয়াল ধান-চালের বাজার কীভাবে অস্থির করছে তার বিবরণ দেন বাংলাদেশ অটো মেজর ও হাস্কিং রাইস মিলমালিক সমিতির কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জায়নুল আবেদীন। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, বড় বড় মিলমালিক এবং গ্রুপ অব কোম্পানিগুলো ধানের মৌসুম শুরু হলেই হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে সারা দেশে নেমে পড়ে। এক্ষেত্রে তারা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে এলাকাভিত্তিক এজেন্ট নিয়োগ দেয়। এসব এজেন্ট কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে ধানের বাজার চষে বেড়ায়। যেখানেই ধান কেনাবেচা হয় সেখানেই এসব প্রতিষ্ঠানের এজেন্টদের দেখা যায়। তারা এক রকম প্রতিযোগিতা করে ধান কেনে। এভাবে তাদের কারণে ধানের দাম বেড়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে চালের বাজারে। তাদের কারণে সারা দেশের ছোট ও মাঝারি মিলমালিকরা ধান কিনতে পারছেন না। মৌসুমের পুরো ধানই চলে যাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের জিম্মায়। এটাই চলতি বোরোর ভরা মৌসুমেও চালের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ।

চালের বড় পাইকারি ব্যবসায়ীরা উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন মিল ও চাতালের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিনের নির্ধারিত বাজারমূল্যে চাল কিনে থাকেন। তারা বাকি বা নগদ দামে কিনে নেওয়া এসব চাল আড়তে এনে বিক্রি করা হয় ছোট পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। এ পদ্ধতিতে চালের দাম চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল থাকে। সরবরাহ বাড়লে দাম কমতে থাকে। আর সরবরাহ কমতে শুরু করলে দামও বেড়ে যায়- এটাই চাল বিপণনের প্রচলিত পদ্ধতি। কিন্তু বড় শিল্প গ্রুপগুলো চাল বিপণনে আসায় বাকিতে চাল কেনার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। ফলে সঙ্কটকালে এমনকি ভরা মৌসুমেও চালের বাজারে সরবরাহ চেইনকে স্থিতিশীল রাখা যাচ্ছে না।

আছে কালো টাকার ছড়াছড়ি
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ধান-চালের বাজারে কালো টাকা ঢুকেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিছু লোকের হাতে প্রচুর টাকা রয়েছে, বিনিয়োগের ভালো কোনো জায়গা না পাওয়ায় তারা ধান-চালের বাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এরা হয়ে গেছেন হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ধান-চাল ব্যবসায়ী, এদের হাতেই চলে গেছে ধানের মজুদ। মূলত এ কারণেই বোরোর ভরা মৌসুমেও সারা দেশে ধানের জন্য হাহাকার, আর চালের বাজার বেসামাল। সরকার লাখ লাখ টন চাল আমদানি করেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না চালের দাম।

এর সত্যতা স্বীকার করেছেন খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খাতুন। সময়ের আলোকে তিনি এ বিষয়ে বলেন, অনেক নতুন নতুন লোক ধান-চালের ব্যবসায় নেমেছে। কারণ তারা টাকা বিনিয়োগের আর কোনো জায়গা হয়তো খুঁজে পায়নি করোনাকালে। তাদের অনেকেই ধান কিনে রেখেছে। তবে কেউ কালো টাকা দিয়ে ধান-চাল কিনে মজুদ করেছে কি না, সেটি আমি বলতে পারব না। সাদা টাকাও বিনিয়োগ হতে পারে। এ ছাড়া করোনাকালে অনেক ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা হয়তো টাকা জোগাড় করে ধান-চালের ব্যবসায় নেমেছে। এ ধরনের ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুদ করে রাখছে, হয়তো লাভ পেলে ছেড়ে দিচ্ছে। এই ধরনের ব্যবসায়ী অনেক বেড়ে গেছে। এভাবে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীদের হাতে অনেক ধান চলে গেছে। এতে বাজারে ধানের সরবরাহ কমে গেছে, ফলে ধানের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে চালের বাজারে, বাড়ছে চালের দাম।

তিনি আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি কোথাও ধান-চালের অবৈধ কোনো মজুদ আছে কিনা। সরকারের অনুমোদিত পরিমাণে মজুদ যদি কারও কাছে থাকে তা হলে তো কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু কেউ যদি ধান-চালের অবৈধ মজুদ করে রাখে তাকে তো কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তবে কৃষক পর্যায়ে বা মৌসুমি ব্যবসায়ী পর্যায়ে যদি মজুদ থাকে সেক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মিলমালিক বা অনুমোদিত ব্যবসায়ীরা বড়তি মজুদ রাখলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। এসব কারণে বোরোর বাম্পার ফলন হলেও এর সুফলটা পাওয়া যাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এখন ২০ হাজার হাস্কিং ও অটো রইস মিল রয়েছে। সারা বছর কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে এই মিলমালিকরাই মাড়াই করে বাজারে চাল সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু এবারের বোরো মৌসুমে মিলমালিকরা ধান কিনতে গিয়ে ধান পাচ্ছে না। কারণ বাজারে সরবরাহ কম। অধিকাংশ ধান চলে গেছে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীদের কবলে। যেসব এলাকায় বেশি চালকল রয়েছে সেসব এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের বোরো মৌসুমের একেবারে শুরু থেকেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী মাঠে নেমেছিলেন। এ ধরনের ব্যবসায়ীর আনাগোনা দেখা যাচ্ছে মূলত গত বছর থেকে। এই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভরা মৌসুমে কম দামে কিনে মজুদ করে রেখে অফ সিজনে চড়া দামে বিক্রি করছে। একেক জন ৫০ গাড়ি, ৬০ গাড়ি ধান মজুদ করে রাখছে। এদের অধিকাংশই অবৈধ টাকার মালিক।

দালালরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কুষ্টিয়ায়
এদিকে সময়ের আলো কুষ্টিয়া প্রতিনিধি মো. ইসমাইল হোসেন জানান, কৃষক ও মিলমালিকদের কাছ থেকে চাল কিনে নিচ্ছে দেশের বড় বড় কোম্পানি। বড় বড় কোম্পানির দালালরা টাকা নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার সব গ্রাম। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক খাজা নগরের ছোট এক মিলার বলেন, আমাদের খাজা নগরের বেশ কিছু মিলমালিক বড় কোম্পানির কাছে চাল বিক্রি করে। তবে দালালদের মাধ্যমে বেশি চাল কিনে নিয়ে যাচ্ছে বড় বড় কোম্পানি। বর্তমানে রূপপুরে একটি বড় কোম্পানির চালের মিল আছে। সেখানে কুষ্টিয়ার মিলমালিকরা ট্রাকে করে চাল পাঠিয়ে দেয়।

জানতে চাইলে কুষ্টিয়া চালকল মালিক সমিতির নেতা ওমর ফারুক বলেন, তারা মিল গেট থেকে যে দামে চাল বিক্রি করছেন, খুচরা বাজার তার চেয়ে অনেক বেশি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। তদারকির অভাবে যদি খুচরা বাজারে বেশি দামে চাল বিক্রি হয় তার দায় মিলমালিকদের না।

হাবিবুর রহমান নামের আরেক মিলমালিক বলেন, এখন অনেক বড় বড় ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠান চালের ব্যবসায় আসছে। আগে শুধু মিলারদের কাছে ধান মজুদ থাকত; কিন্তু এখন ওইসব ব্যবসায়ীর কাছেও চালের মজুদ থাকে। আবার গ্রামে এবং মাঠ পর্যায়ে ও অনেক সিজনাল ব্যাবসায়ী তৈরি হয়েছে, যারা নিজ এলাকায় গোডাউন তৈরি করেও ধানের মজুদ করে রাখছে। গত দু-তিন বছর ধরে ধানের বাজার ভালো থাকায় অনেক চাষিও তাদের ধান আটকে রাখছেন। এ কারণে এখন ধানের উৎপাদন ভালো হলেও সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে এখন মাঠ পর্যায় থেকে তদারকি করতে হবে বলে জানান এ মিলমালিক।

(সময়ের আলোতে প্রকাশিত)