৩৪ হাজার কোটি টাকার কসমেটিকস বাজার চোরাকারবারিদের দখলে!

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি কিংবা ত্বক পরিচর্যায় কসমেটিকস অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কসমেটিকস খাতের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। যার প্রায় ৯৭ ভাগের জোগান আনুষ্ঠানিক উৎসহীন। এগুলো আসে নকল পণ্য তৈরি এবং শুল্ক ফাঁকি দেওয়া আমদানির মাধ্যমে। এতে ক্রেতারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বলছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে দেশে ২০-৩৯ বয়সী নারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৭৩ লাখ ৬২ হাজার ৬৮৮ জন। নারীদের এই সংখ্যার ৭০ ভাগকে প্রসাধনী সামগ্রীর সম্ভাব্য ক্রেতা বিবেচনা করলে দেশে কালার কসমেটিকসের চাহিদা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার এবং স্কিন কেয়ার পণ্যের চাহিদা প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার। দুই খাত মিলিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে দেশে কসমেটিকস খাতের বাজার প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার।

বিপরীতে এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬২৭ কোটি টাকার কালার কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্য থেকে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদ সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২৮৮ কোটি টাকা। একইভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫২৮ কোটি টাকা, যার শুল্ক ও মূসকের পরিমাণ ছিল ২৪২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন ও এনবিআরের পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে, দেশের কসমেটিকস খাত প্রকৃত অর্থে কালোবাজারিদের দখলে আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাবেই প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার কসমেটিকস পণ্যের চাহিদা পূরণ হয় অবৈধ পন্থায় আমদানি করা পণ্য ও নকল পণ্যের মাধ্যমে। বাজারের মোট চাহিদার প্রায় ৯৭ ভাগ হিসাবের বাইরে। ফলে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

যদিও প্রসাধনী আমদানিকারক সংশ্লিষ্ট সমিতি বলছে, বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী আমদানি হয় বাংলাদেশে। তাদের হিসাব বিবেচনা করলেও ২৪ হাজার কোটি টাকার কসমেটিকস প্রসাধনীর বাজার কালোবাজারিদের দখলে আছে। ওই হিসাবে ৭০ শতাংশ কসমেটিকস পণ্যের বাজার কালোবাজারিদের দখলে।

অথচ পলিসিগত সহায়তা ও স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় কর সুবিধা পাওয়া গেলে চাহিদা পূরণে দেশীয় শিল্প গড়ে উঠতে পারে, যার মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

এ কারণে আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার সুপারিশের পাশাপাশি এসব পণ্যের কাস্টমস ডিউটি কেজিতে নির্ধারণ ও ট্যারিফ ভ্যালু উঠিয়ে যথাযথ শুল্কায়ন করে আমদানিকৃত পণ্যের উৎস, ব্র্যান্ড ও বাজারমূল্য বিবেচনায় নির্ধারণ করার সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন।

ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ ও গবেষণা প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স ও এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, আমি বলব অবশ্যই এর সত্যতা রয়েছে। কসমেটিকসের বাজারের পরিসর অনেক। কিন্তু সে অনুযায়ী দেশীয় শিল্প গড়ে ওঠেনি। আমাদের দেশের চাহিদার বড় অংশই পূরণ হয় শুল্ক ফাঁকি দেওয়া কসমেটিকস ও নকল পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে। যে কারণে সরকার বিশাল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে।’

দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের নীতিগত সহায়তার দাবি করে কসমেটিকস আমদানিকারকদের এই নেতা বলেন, ‘দেশের চাহিদা অনুযায়ী যদি দেশীয় শিল্প প্রসারিত হয় অন্তত ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। কসমেটিক্স পণ্যের বাজার বড় হলেও এত দিনেও দেশীয় ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়ায়নি। ফলে আমদানি নির্ভরতায় বড় অংকের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশীয় শিল্প স্থাপনে সরকারের পলিসি সাপোর্ট বড় একটি বিষয়। এখন কসমেটিক্সের কাঁচামাল ও তৈরিকৃত পণ্যের দাম বেশি পড়ে যায়। কারণ কাঁচামালে শুল্ক-কর বেশি, বিপরীতে সরাসরি কসমেটিক্স আমদানিতে শুল্ক-কর কম। যে কারণে দেশীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছে না।’

তিনি বলেন, ‘বাজারের চাহিদা পূরণে অসৎ ব্যবসায়ীরা হয় মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য দেশে আনছে, না হয় স্থানীয়ভাবে নকল পণ্য তৈরি করে তা সরবরাহ করছে। ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা যেমন বিপাকে পড়ছে, তেমনি নকল পণ্যের ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।’

অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স ও এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশ, কালার কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রিমার্ক এইচবি লিমিটেডের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এমন প্রতিবেদন তৈরি করে গত ৩০ মার্চ এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবর দাখিল করে বলে জানা গেছে। যেখানে স্থানীয়ভাবে কালার কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্য উৎপাদন, আমদানি, স্থানীয় চাহিদা, আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার, স্থানীয় উৎপাদনের পরিমাণ, বিদ্যমান শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ও স্থানীয় বাজারমূল্য ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনা করা হয়।

প্রতিবেদনে ট্যারিফ কমিশন বলছে, বাজারে বিদেশি একটি লিপস্টিক ২০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়। অথচ আমদানির সময় আন্ডার ইনভয়েসিং করে একই পণ্যের ট্যারিফ ভ্যালু দেখানো হয় মাত্র ৪ থেকে সাড়ে ৪ টাকা। শুল্কারোপের পর সেসব লিপস্টিকের দাম দাঁড়ায় ১০ থেকে ১১ টাকা। কালার কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্য আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। করা হচ্ছে অস্বাভাবিক মুনাফা। স্থানীয় বাজারের যে পরিধি তা বিবেচনায় আমদানি পর্যায়ে সরকারের রাজস্বের পরিমাণ নগণ্য বলে মনে করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।

ট্যারিফ কমিশনের তথ্যানুযায়ী, কালার কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্য উৎপাদনে দেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। কয়েকটি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান কালার কসমেটিকসের বিভিন্ন অংশ এনে প্যাকেটজাত করে। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান এ ধরনের পণ্যের প্যাকেজিং সামগ্রী ও কনটেইনার আমদানি করেছে। দেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও আমদানি বহির্ভূত কালার কসমেটিক্স ও স্কিন কেয়ার পণ্যসামগ্রীর অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য রয়েছে।

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের আরও উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে–

কসমেটিকস শিল্পের সম্ভাবনা
পণ্য বহুমুখীকরণের বিষয় বিবেচনা ও আমদানি বিকল্প পণ্য বিবেচনায় এটি একটি ব্যাপক সম্ভাবনাময় খাত। স্থানীয়ভাবে এ পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। তবে হোম কেয়ার অ্যান্ড টয়লেট্রিজ খাতে স্থানীয় বিনিয়োগ বিদ্যমান থাকলেও স্কিন কেয়ার অ্যান্ড কালার কসমেটিকস খাতে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ নেই।

বিনিয়োগ না থাকার অন্যতম একটি কারণ হলো, এ খাতে বিনিয়োগের জন্য প্রথমত দরকার অত্যাধুনিক গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র। স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রিমার্ক এইচবি লিমিটেড ২০২০ সালে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী স্কিন কেয়ার অ্যান্ড কালার কসমেটিকস খাতের বিভিন্ন পণ্য উন্নয়ন করে স্থানীয়ভাবে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে।

স্থানীয় উৎপাদন উৎসাহিত হলে আসবে রাজস্ব
বিদ্যমান অবস্থা ও স্থানীয় চাহিদা বিবেচনায় সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করার কথা তা অর্জিত হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো। কালার কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার খাতে যে কয়েকটি এইচ.এস কোড ব্যবহার করে পণ্য আমদানি হয় সেগুলোর বিপরীতে ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট সম্পূরক শুল্ক ও মূসকের পরিমাণ প্রায় ২৮৮ কোটি টাকা।

স্থানীয় বাজারের পরিধি বিবেচনায় আমদানি পর্যায়ে সরকারের রাজস্বের পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। স্থানীয় উৎপাদন উৎসাহিত হলে কালার কসমেটিকস খাতে ১৩ হাজার কোটি ও স্কিন কেয়ার খাতে ২৩ হাজার কোটি টাকার বাজার বিবেচনায় কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ের শুল্ক, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর আহরিত হলে তা বিদ্যমান রাজস্ব অপেক্ষা অনেক বেশি হবে।

শুল্ক ও কর কাঠামোর সম্ভাব্য পরিবর্তন
স্থানীয় উৎপাদন উৎসাহিত করার লক্ষ্যে কাঁচামাল আমদানি, স্থানীয় উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে শুল্ক ও কর কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হলে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, সরকারের রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বন্ধ হবে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং ব্যাপক পশ্চাৎপদ শিল্প ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাট্রিজ গড়ে উঠবে।

ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে

স্থানীয় শিশু শিল্প বিবেচনায় স্কিন কেয়ার অ্যান্ড কালার কসমেটিকস শিল্পকে নির্দিষ্ট মেয়াদে নিম্নরূপ সুবিধা প্রদান করা–

  • স্থানীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মেয়াদে সম্পূরক শুল্ক (এসডি) অব্যাহতি এবং মূল্য সংযোজন কর শুধু বিক্রয় পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ নির্ধারণ করে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে অব্যাহতি প্রদান করা যেতে পারে।
  • স্থানীয় উৎপাদনে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বিশেষ এস. আর. ও জারির মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াত প্রদান করা।
  • কালার কসমেটিকস খাতে সম্পূর্ণায়িত পণ্য আমদানিতে যথাযথ মূল্যে শুল্কায়ন হওয়ার সুবিধার্থে কাস্টমস ডিউটি (সিডি) প্রতি কেজির মূল্য স্পেসিফিক করা।
  • কালার কসমেটিকস শুল্কায়নের ক্ষেত্রে নেট ওয়েটের পরিবর্তে গ্রস ওয়েট বিবেচনায় শুল্কায়ন করা।

সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।