৮০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করেও সন্তুষ্ট নন ব্যবসায়ীরা

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ ভোক্তাদের কাছে এ দাম আকাশ ছোঁয়া হলেও ব্যবসায়ীরা এ দামে সন্তুষ্ট নন। তাদের হিসাবে দাম আরও বাড়ানো উচিৎ। অথবা গরুর দাম কমানো উচিৎ।

গরুর মাংসের দাম কেন এতো বাড়ছে? কোন বাজারে কত দরে বিক্রি হচ্ছে? গরুর দামই বাড়ছে কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রাজধানীর কয়েকটি বাজারে ঘুরে সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করা হয়েছে।

রাজধানীর কাওরান বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে, মোহাম্মদপুর টাউনহল মার্কেটে ৭৮০ থেকে ৮২০ টাকা, মালিবাগ কাঁচা বাজারে ৭৭০ থেকে ৮০০ টাকা, শান্তিনগর বাজারে ৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মিরপুরের বিভিন্ন বাজারে ৭৫০ টাকা দরে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে, ২০২২ সালে গরুর মাংস প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ২০২১ সালের একই সময়ে গরুর মাংস কেজিপ্রতি দাম ছিল ৫৬০ থেকে ৬০০ টাকা। খাসি ও মুরগির মাংসের ক্ষেত্রেও একই চিত্র ছিল। অর্থাৎ গত তিন বছরে আস্তে আস্তে এগুলোর দাম বেড়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে গরুর মাংসের বাজারের অস্থিরতা শুরু। সে সময় রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছিলো ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে গো-খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং গরুর দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৬৮০ থেকে ৭২০ পর্যন্ত বিক্রি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। সবশেষ চলতি মাস মার্চে আরেক দাম বাড়ানো হয়, প্রতি কেজি গরুর মাংস গিয়ে ঠেকে ৭৫০ টাকা। শব-ই-বরাত উপলক্ষে আরেক দফা বাড়ানো হয় গরুর মাংসের দাম। এরপর থেকে দাম প্রতিদিনই বাড়ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ভেদে মাংসের দাম কিছুটা কম বেশি হলেও দাম আরও বাড়বে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

গরুর মাংস বিক্রেতারা জানান, আসন্ন কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে খামারিরা গরুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি গরুতে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি দামে গরু কিনলে মাংসের দামও বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। ঈদের আগে দাম আরও বাড়বে। কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।

মোহাম্মদপুর টাউনহল মার্কেটের রমজান দেওয়ান গোস্ত বিতানের মালিক রমজান দেওয়ান বলেন, ‘রোজার ঈদের পরে মাংস বিক্রি কম। এখন বাজার দর চলছে ৮৫০ টাকা। তবে আমরা ৭৮০ থেকে ৮২০ টাকা দরে বিক্রি করছি। তবে এ দামে পোশাচ্ছে না। গরুর দাম অনুযায়ী মাংসের দাম আরও বাড়তি হওয়া উচিত। কুরবানির আগে গরুর দাম আরও বাড়বে। তখন মাংসের দাম আরও বেড়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে গরু কিনতে গেলে তখনই দাম পড়বে ১১০০ টাকা কেজি। তখন কোসাই এর দোকানেও মাংসের দাম বাড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গরুর মাংসের দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতার সংখ্যা কমেছে। আগে যেখানে একদিনে তিন-চারটা গরু বিক্রি করতাম, এখন একটা গরু দুই দোকানেও বিক্রি করতে পারছি না। ক্রেতাই নেই। অনেক সময় লোকসান করে গরুর মাংস বিক্রি করতে হচ্ছে।’

আব্দুল হক নামের আরেকজন মাংস বিক্রেতা বলেন, ‘গরুর দাম অনুযায়ী মাংসের দাম এখন কম। ক্রেতা না থাকায় কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। মানুষের কাছে এখন টাকা নেই। আর টাকা না থাকলে এতো দাম দিয়ে গরুর মাংস খাবে কিভাবে? আমাদের মত অনেক ব্যবসায়ী লোকসান করে গরুর মাংস বিক্রি করছে।’

অপরদিকে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশন বলছে, বাজারে গো-খাদ্যের দাম ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে বেড়ে গেছে গরুর উৎপাদন খরচ। সরকার গো-খাদ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নিলে বাজারে মাংসের দাম কমে আসবে।

এর বাইরে রয়েছে পশুর ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, চামড়ার দাম কমে যাওয়া, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ বৃদ্ধি। প্রকৃতপক্ষে খামারির কাছ থেকে কসাই পর্যন্ত একটি গরু পৌঁছাতে তিন-চার হাত বদল হয়। প্রতি হাত বদলে বাড়ে গরুর দাম।

আরেকটি তথ্য হচ্ছে, গত কয়েক বছরে গরু পালন আর প্রান্তিক খামারিদের হাতে নেই। রাজনৈতিক দলের নেতা, সংসদ সদস্যসহ বড় বড় ব্যবসায়ীর হাতে চলে গেছে। তারাই এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।

‘গরু, খাসি ও মুরগীর মাংসের দাম এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেনু থেকে মাংস এখন উধাও হবার পথে’ বলে মনে করেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।

তিনি বলেন, ‘যেভাবে বাজারে মাংসের দাম বাড়ছে- তা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ যারা এই খাত নিয়ে কাজ করেন তাদের উচিৎ মাংসের দাম বৃদ্ধির পেছনে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা। তা না হলে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত বাড়তি দাম দিয়ে প্রতারিত হবেন। এক্ষেত্রে আমি মনে করি জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার মনিটরিং আরও জোড়দার করা উচিৎ।’

মাংসের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ সব সময়ই প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর কমবেশি নির্ভরশীল ছিল। ভারত থেকে গরু আসত সারা বছরই। তবে শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে আসত কোরবানি ঈদের আগে। এ দেশের হাটগুলো ভরে উঠতো ভারতীয় গরুতে। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশে গরু পাঠানোর ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করে। ২০১৫ সালের ০১ এপ্রিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের এক নির্দেশনার পর সে দেশ থেকে বাংলাদেশে গবাদিপশু আসা একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়।