অনলাইনে পণ্য বিক্রির সঙ্গে বেড়েছে প্রতারণাও

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে মানুষের অনলাইনে সম্পৃক্ততা বেড়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে অনলাইন বিসজেন প্ল্যাটফর্ম। অনলাইনে মানুষের কেনাকাটাও বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে প্রতারণাও।

অনলাইনে পণ্য কিনে প্রতারিত ভোক্তাদের অনেকের অভিযোগ, অনলাইনে যে পণ্য দেখানো হয়েছে, সেই পণ্য না দেওয়া, পণ্যের গুণগত মান ঠিক না থাকা, সময় মতো ডেলিভারি না দেওয়া, অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য না দেওয়া, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য পরিবর্তনে সাড়া না দেওয়া এবং রিফান্ডের টাকা ফেরত পেতে দেরি হওয়া।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নামে-বেনামে হাজারো প্রতিশ্রুতি দিয়ে গড়ে ওঠা এসব অনলাইন বিজনেস অনেকটাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেইজ নির্ভর। কোনো কোনো অনলাইন ব্যবসার সঠিক ঠিকানা পর্যন্ত দেওয়া নেই। মূলত না বুঝে এসব অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য ক্রয় করায় হর-হামেশাই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ভোক্তারা।

ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়েরের ৮০ শতাংশই অনলাইনে প্রতারণা শিকার। তবে নিয়মিত অভিযোগ এলেও অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঠিক তথ্য না থাকায় দ্রুত বিচারের আওতায় আসছে না।

অনলাইনে পণ্য কিনে প্রতারিত হয়েছে এমন ১০ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে ভোক্তাকণ্ঠের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। জানতে চাওয়া হয়, কিভাবে প্রতারিত হয়েছেন তারা?

আরিফুল ইসলাম রাজু নামের একজন ভোক্তা অনলাইন বিজনেস প্ল্যাটফর্ম দারাজ থেকে একটি বেবি কেরিয়ার বেল্ড অর্ডার করেন। দাম লেখা ছিল ৫৫০ টাকা।

তিনি বলেন, ‘দুই দিন পরে তিনি পণ্যটি হোম ডেলিভারি পান। ডেলিভারি বয়ের সামনে পণ্যটি খুলে দেখে নিতে চাইলে, ডেলিভারি বয় জানান, পণ্য খুলে দেখে নেবার কোনো সুযোগ নেই। ক্যাশ অন ডেলিভারিতে টাকা আগে পরিশোধ করতে হবে। পরে পণ্য নেওয়ার পর যদি পছন্দ না হয় যথাযথ কারণ দেখিয়ে সাত দিনের মধ্যে রিটার্ন করতে পারবেন। পরে পণ্যের টাকা পরিশোধ করে দেওয়া হয়।’

ভুক্তভোগী বলেন, ‘বেবি কেরিয়ার বেল্ড মোড়ক থেকে খুলে দেখা যায়, এটি খুবই নিম্মমানের। যা ব্যবহার করার উপযোগী নয়। এর দাম ৩০০ টাকার বেশি হবে না। সঙ্গে সঙ্গে দারাজের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পণ্যটি রিটার্ণ করার আবেদন করা হয়। আবেদনের একদিন পর পণ্যটি নিয়ে গেলেও পণ্যের দাম নগদে ফেরত দেয়নি। বরং টাকাটি দারাজের ক্যাশ ভাউচারে গিয়ে জমা হয়। অর্থাৎ ওই টাকা দিয়ে আমাকে দারাজ থেকে পণ্য কিনতে হবে। এছাড়া নগদে টাকাটা পাচ্ছি না। পরে বাধ্য হয়ে নতুন অন্য একটি পণ্য কিনে দারাজের ভোক্তান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছি।’

মো. এহতাশামুল হক নামে আরেকজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবহার করে Priyoshop.com অনলাইন শপ থেকে Realme ফোন এর (2X ভাউচার ৩০ হাজার টাকার সমমূল্যমান) ডাবল ভাউচার (নগদ মোবাইল ব্যাংকিং পেমেন্টের ২০ শতাংশ ডিসকাউন্টে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা) ডিসকাউন্ট পেয়ে ১৪ হাজার ৫০০ টাকায় ক্রয় করি। অর্ডার নাম্বার: ৪০৭২০২, ক্রয়কৃত মূল্য নগদ মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পুরোপুরি পরিশোধ করে দেয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের ১৫ জুলাই ইন্টারনেট ব্যবহার করে Priyoshop.com থেকে নয় হাজার ৯০০ টাকার মাইক্রোওয়েভ ওভেন নগদ পেমেন্ট করলে ২০ শতাংশ ডিসকাউন্ট এরপর সাত হাজার ৫০৭ টাকায় অর্ডার করি। অর্ডার নাম্বার: ৪১৬৫৪৭, যা নগদ মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পুরোপুরি পরিশোধ করা হয়। আমার এই পণ্যগুলো পরবর্তী মাসের ৩১ তারিখে ডেলিভারি দেয়ার কথা থাকলেও ডেলিভারি করতে ব্যর্থ হওয়ায় পুনরায় এক মাসের সময় নেয়। পরবর্তীতে আবারও ব্যর্থ হওয়ায় রিফান্ডের জন্য অনুরোধ করি। এরপর থেকে সাত বার এক মাস, দুই মাস করে নতুন তারিখ দেওয়া হয়। এবং প্রতিটি তারিখে রিফান্ড করতে ব্যর্থ হয় এবং আমি হয়রানির শিকার হই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে এক বছর কেটে গেলেও আমি নিজে কল সেন্টার থেকে ফোন করে জেনে নেই ডিসেম্বর ২০২২ এর মধ্যে রিফান্ড করে দেয়া হবে। কিন্তু সেই টাকা আর রিফান্ড হয়নি।’

মুনা শাহ শামীমা নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘one purchase bd নামের একটা অনলাইন পেইজ আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এমনিতেই পণ্য দেরিতে দিয়েছে তারা। পণ্য আসার পর দেখলাম ডিফেক্ট পণ্য। এই রকম পণ্য দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলাম, তারা বললো সরি ঈদের টাইম, তাড়াহুড়ো করে চেক করতে পারিনি। পরে বললাম এইটা তো আমি ব্যবহার করতে পারবো না আমাকে চেঞ্জ করে দেন। পরে তারা আমাকে বলেন ঈদের পরে যোগাযোগ করতে। ঈদের পর যোগাযোগ করলাম, কারণ ডেলিভারি চার্জ ছিল ১৩০ টাকা আর পণ্যের দাম ১১০০ টাকা। যেহেতু অনেক টাকা গেছে তাই আমি যোগাযোগ করলাম আবার। তারা বললো আমাকে আবারও ডেলিভারি চার্জ দিয়ে পাঠাতে হবে। এর অর্থ দাঁড়ায় আমি দু’বার ডেলিভারি চার্জ দেব। অথচ ভুল ছিল তাদের।

তিনি আরও বলেন, ‘পরে আমি তাদের ফেসবুক পেইজে মেসেজ করি, তারা দেখে কিন্তু আমার মেসেজের রিপ্লাই দেয় না। পরে আমাকে ব্লক করে দেয়। তাদের দেওয়া নাম্বারে যোগাযোগ করেও পাইনি।’

আফিয়া আশরাফ নামের একজন ভুক্তভোগী বলেন, “Farista” নামের একটি ফেসবুক পেইজ থেকে আমি একটি জামদানী শাড়ি অর্ডার করি গত বছরের অক্টোবর মাসে। তারা অর্ডার কনফার্ম করে এক সপ্তাহ পরে বলে শাড়িটি নেই, অন্য একটি শাড়ি যেন আমি নেই। আমি রাজি হয়ে অন্য একটি শাড়ি পছন্দ করি এবং অর্ডার দেই। শাড়িটি ফুল ফ্রেশ বলে তারা আমার কাছে বিক্রি করে এবং আমি বাসায় না থাকায় আমার ভাই শাড়িটি রিসিভ করে। আমি যখন শাড়িটি দেখি তখন দেখতে পাই শাড়িতে তিন জায়গায় রিপু করা এবং এক জায়গায় ছেঁড়া। আমি তাদের ভালো ভাবেই বিষয়টি জানাই এবং তখন আমাকে অন্য একটি শাড়ি পছন্দ করতে বলেন। আমি তাদের ঠিকানা নিতে চাই কারণ আমি শাড়িটি ফেরত দিতে চেয়েছিলাম। তারা আমাকে অন্য একটি শাড়ি দিয়ে পরিবর্তন করার কথা বলেন। তাতেও আমি তাকে সুযোগ দেই। কিন্তু তারা আমাকে কিছুদিন ঘুরিয়ে আর আমার এসএমএসের রিপ্লাই করেনি।’

অনলাইনে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘ভোক্তারা নিয়মিত বিভিন্ন ভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তবে ইদানিং অনলাইনে পণ্য কেনা নিয়ে প্রতারণা হওয়ার বিষয়টি খুব বেশি শোনা যায়। এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কাজ করছে। ভোক্তা-অধিকার আইন সংশোধনীতে ই-কমার্স বিষয়ে আলাদা আইন যুক্ত করতে সুপারিশ করা হয়েছে। আইনটি বাস্তবায়ন হলে অনলাইনে প্রতারিত হলে ভুক্তভোগীরা ভোক্তা-অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিকার পাবেন।’

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ভোক্তা-অধিকার আইন ২০০৯ যখন বাস্তবায়ন হয় তখন অনলাইনে পণ্য বিক্রির বিষয়টি ছিল না। বর্তমানে অনলাইনে পণ্য বিক্রি যেমন বেড়েছে প্রতারণাও বেড়েছে। প্রতিনিয়ত পণ্য কিনে প্রতারিত হয়ে আমাদের এখানে অভিযোগ করেন ভোক্তারা। তবে বেশির ভাগ ফেসবুক পেইজের সঠিক কোনো ঠিকানা বা যোগাযোগ নাম্বার থাকে না।’

তিনি বলেন, ভোক্তা-অধিকার আইনের সংশোধনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। নতুন আইনে ই-কমার্সকে যুক্ত করতে সুপারিশ করা হয়েছে।’

-এসআর