৪০ কেজি দুধের ৩০ কেজিই ভেজাল

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সাতক্ষীরার দুগ্ধপল্লী হিসেবে খ্যাত জেয়ালার ঘোষপাড়া গ্রাম। অল্প দিনে কোটিপতি বনে গেছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। তবে গরুর দুধ নয়, এখানে গ্লুকোজ, পানি, চিনি ও গাম জেলি দ্বারা তৈরি হয় ‘খাঁটি দুধ’। এই দুধ সরবরাহ করা হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দুগ্ধপল্লীর অধিকাংশ ঘোষ কয়েক বছর আগেও ছিলেন অন্য খামারিদের কর্মচারী। সামান্য মুজুরিতে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। তবে কয়েক বছরের ব্যবধানে ভেজাল দুধ বিক্রি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন অনেকে। তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, কিনেছেন ট্রাকসহ সম্পত্তি।

জানা যায়, খামারিদের কাছ থেকে মিল্কভিটা, আকিজ, প্রাণসহ অন্যান্য কোম্পানি যে দামে দুধ ক্রয় করে, তার চেয়ে কেজি প্রতি ২ থেকে ৩ টাকা কমে দুধ ক্রয় করেন স্থানীয় দুগ্ধপল্লীর ঘোষেরা। কম দামে দুধ ক্রয় করে তাতে কেমিক্যালের মিশিয়ে সেই দুধ ৭ থেকে ১০ গুণ বৃদ্ধি করেন। যাদের গরু নেই তারাও শুধু কেমিক্যাল ব্যবহার করে দুধ তৈরি করেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

তালা সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম জানান, ঘোষপাড়ার প্রতিটি বাড়িতে দিনে দুই থেকে তিন বার যাতায়াত করতে হয় বিভিন্ন প্রয়োজনে। বিভিন্ন সময় তাদের ভেজাল দুধ তৈরির কর্মযজ্ঞ সামনে পড়ে। নিষেধ করলেও তারা অমান্য করে দীর্ঘদিন ধরে এটি চলমান রেখেছেন। যদি কেউ ১০ হাজার লিটার দুধের অর্ডার দেন, তবে এই ঘোষেরা কেমিক্যাল দিয়ে ১০ হাজার লিটার দুধ তৈরি করে দেন। এমনকি আরও অতিরিক্ত ২ হাজার লিটার থেকে যায়, যেটা স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি করেন তারা।

তিনি আরও জানান, এমন অনেক ঘটনা আছে, যাদের গাভি নেই তারাও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে দুধ তৈরি করে বিক্রি করে কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। এ সব ব্যবসায়ীর কারও এক কাঠা জমিও ছিল না। তারা এখন দুই তলা বাড়ি, দামি গাড়িসহ কোটি টাকার সম্পত্তি তৈরি করেছে ভেজাল দুধ বিক্রি করে।

প্রাণ ডেইরির চিলিং সেন্টারের ল্যাব সহকারী সঞ্জয় দত্ত থেকে জানান, পর্যাপ্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা দুধ সংগ্রহ করে থাকি। চলতি মাসে ৭ জনের ভেজাল দুধ শনাক্ত হয়েছে। তাদের কাছ থেকে আমরা দুধ সংগ্রহ করছি না।

অপরদিকে আকিজ ডেইরির চিলিং সেন্টারের ল্যাব সহকারী রাজিব হোসেন জানান, ফ্যাট অনুযায়ী দুধ সংগ্রহ করা হয়। যাদের দুধে ফ্যাট বেশি তাদের দাম বেশি দেওয়া হয়। ভেজাল দুধ দেওয়ার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীদের দুধ সংগ্রহ করি না। এখন শুধুমাত্র খামারিদের দুধ সংগ্রহ করা হয়।

তবে সাংবাদিকদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে ঘোষপাড়ার অধিকাংশ অসাধু ব্যবসায়ী গা ঢাকা দেন। এ সময় শুকান্ত ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ী সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে বলেন, দুধ পরীক্ষা করে দেখেন, ভেজাল আছে কিনা।

এ বিষয়ে তালা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল কুদ্দুস বলেন, সাতক্ষীরার জেয়ালা ঘোষপাড়া দুগ্ধপল্লী নামে পরিচিত। কিছু দিন ধরে অভিযোগ পাচ্ছিলাম রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে তারা নকল দুধ তৈরি করে। তারই ধারাবাহিতায় গত মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) ৩৫০ কেজি ভেজাল দুধ তৈরির জেলি ও ৯৬৫ কেজি ভেজাল দুধসহ প্রশান্ত নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

তিনি আরও জানান, ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া চিলিং সেন্টারগুলোকে যাচাই-বাছাই করে দুধ সংগ্রহ করতে বলেছি। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার জানান, ভেজালবিরোধী অভিযান চলমান রয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেই সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে। তাছাড়া চিলিং সেন্টারগুলোকে ভেজাল দুধ শনাক্তের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) ভেজাল দুধ তৈরি ও বিক্রির দায়ে ৩৫০ কেজি জেলি ও ৯৬৫ কেজি ভেজাল দুধসহ দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি প্রশান্ত ঘোষকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন। এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর রাতে তালা উপজেলার মহান্দি গ্রামের শংকর দাস দুই ড্রাম গাম জেলিসহ পুলিশের হাতে আটক হন। পরবর্তীতে তাকেও দুই মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।